প্রথম লঞ্চটা চলে যাবার পর পরের লঞ্চ ‘‘নটিলাস’-এ একই প্রক্রিয়ায় উদ্বাস্তুদের তুলে ফেলল নিরঞ্জনরা। সবাই উঠলে আন্দামানের চিফ কনজারভেটর অফ ফরেষ্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল, চিফ মেডিকেল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ, হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট ও রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ইন-চার্জ বিশ্বজিৎ রাহা এবং আরও কয়েকজন বড় মাপের অফিসার।
অফিসার এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা ছাড়াও পোর্ট ব্লেয়ারের আরও অনেক পুরনো বাঙালি বাসিন্দা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিল। বোঝাতে চেয়েছিল বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সুদুর এই দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। এখানেও তাদের অগুনতি শুভাকাক্ষী রয়েছে। সবসময় আত্মীয় পরিজনের মতো এরা পাশে থাকবে। দুটো মোটরলঞ্চে এই আন্দামানবাসী বাঙালিদের জায়গা হয়নি। ‘রস’ আইল্যান্ডের জেটিতে একজোড়া মোর্টর বোট বাঁধা রয়েছে। ছোট জলযান দুটো তাদের নিয়ে আসবে।
যে দুই স্টিম লঞ্চ উদ্বাস্তুদের নিয়ে সেসোস্ট্রেস বের জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে তার একটার নাম ‘সি-গাল’, অন্যটা ‘‘নটিলাস’। এই তো সবে ইংরেজ রাজত্বের অবসান হল। তাদের দেওয়া লঞ্চের নামগুলো এখনও টিকে আছে।
‘‘নটিলাস’-এর দোতলার ডেকে রেলিং ধরে দূরমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। চারপাশের দৃশ্যাবলি ছাপিয়ে একটি মুখ স্থিরচিত্রের মতো চোখের সামনে কোনও অদৃশ্য ফ্রেমে আটকে আছে। পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল, ‘ছুটোবাবু–’
ঘুরে দাঁড়াতেই বিনয়ের চোখে পড়ল হলধর সূত্রধর। বুড়োটে, কুঁজো ধরনের লোকটার আদি বাড়ি ছিল রাজদিয়ার কাছাকাছি একটা গ্রাম-গিরিগঞ্জে। দেশে থাকতে মাঝে মাঝে হেমনাথের কাছে আসত সে। দেশভাগের পর কোথায় ছিটকে পড়েছিল, বিনয় জানে না। অনেক কাল বাদে এই সেদিন দমদমের এক ত্রাণশিবিরে তার সঙ্গে দেখা। তারপর স্টিমশিপ ‘মহারাজায়। তারপর ‘নটিলাস’ লঞ্চে।
বিনয় জিগ্যেস করে, ‘কিছু বলবেন?’
‘হ—’ আস্তে মাথা নাড়ে হলধর।
সামান্য কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
হলধর বলে, ‘শুনাশুন একহান কথা কানে আইছে।’
‘কী?’
‘আমাগে নিকি (নাকি) পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ার) রাখব না। মেলা (অনেক) দূরে জঙ্গলে লইয়া যাইব। হেগুলা (সেসব) কেমুন জাগা (জায়গা), কেঠা জানে।’
খবরটা নতুন নয়। নিরঞ্জন আগেই বিনয়কে জানিয়েছে, পোর্ট ব্লেয়ার শহর থেকে তিরিশ-চল্লিশ মাইল পশ্চিমে উদ্বাস্তুদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বসানো হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। পূর্ব বাংলার ছিন্নমূল মানুষদের বাসস্থান। সেই এলাকাগুলো ঠিক কী ধরনের সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নেই বিনয়ের।
হলধর বলতে লাগল, ‘হোনলাম (শুনলাম) যেইহানে আমাগো লইয়া যাইব হের (তার) চাইর পাশে আলিসান আলিসান জঙ্গল। জংলি জারোরা (জারোয়ারা) কাছাকাছিই থাকে। বিষমাখা তির ফ্যাকে (ছোড়ে)।
বিনয় রীতিমতো অবাক। গিরিগঞ্জের হলধর সূত্রধর, যে কোনওদিন স্কুলের ধারাকাছে ঘেঁষেনি, অক্ষরপরিচয়হীন বেজায় সাদাসিধে, দেশভাগের আগে বিক্রমপুরের চৌহদ্দির বাইরে কখনও কোথাও যায়নি, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছেছিল। এখন স্টিমঞ্চ ‘নটিলাস’-এ পোর্টব্লেয়ার চলেছে। এই সময়টুকুর মধ্যে কত তথ্যই না সংগ্রহ করে ফেলেছে।
হলধর থামেনি। ‘জারোরা নিকি কয়জন ‘রিফুজ’রে মাইরা ফালাইছে। ছুটোবাবু, ডরে বুক কাপে।’
হলধরকে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে আরও পনেরো-কুড়িজন উদ্বাস্তু ডেকের নানা দিক থেকে চলে এসেছে। সবারই মুখ চেনা। দু-চার জনের নামও জানে বিনয়। দেশ থেকে উৎখাত হয়ে হলধরের সঙ্গে এরা দমদমের ত্রাণশিবিরে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। সবার চোখেমুখে গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ। সৃষ্টিছাড়া আদিম অরণ্যে হিংস্র জারোয়াদের পাশাপাশি থাকতে হবে, হলধরের মতো এই খবরটা নিশ্চয়ই তারাও পেয়ে গেছে। এদেরই একজন মাখন রুদ্রপাল বলল, ‘জারোগো হাতে মারণের লেইগা কি গরমেন (গভর্নমেন্ট) আমাগো এই আন্ধারমান দ্বীপি লইয়া আইল ছুটোবাবু?’ হলধরের দেখাদেখি দমদম ক্যাম্পের আরও অনেকেই বিনয়কে ‘ছুটোবাবু’ বলে।
ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হাজার মাইল দূরের এই দ্বীপপুঞ্জে জঙ্গলের ভেতর এখানকার আদি বাসিন্দাদের তীরের মুখে শরণার্থীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানেই হবে তাদের নতুন স্থায়ী বাসস্থান, ভাবতেই ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে বিনয়ের। দেশ ছেড়ে চলে আসার পর শিয়ালদা স্টেশনে আর ত্রাণশিবিরে কী নিদারুণ দুর্গতির মধ্যে যে এদের দিন কেটেছে। সেটাকে বেঁচে থাকা বলে না। ক্ষয়ে ক্ষয়ে তারা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভয়, দ্বিধা কাটিয়ে আন্দামানের জাহাজে উঠেছে। তাদের জানানো হয়েছে সমুদ্রের মাঝখানে তাদের যে নিজস্ব বাসভূমি হবে তা সম্পূর্ণ নিরাপদ, ঝাটমুক্ত। পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে যে জীবন তারা চিরতরে ফেলে এসেছে, ফের তা গড়ে তুলবে অসীম পরিশ্রমে অফুরান মমতায়। যা হারিয়েছে তার বহুগুণ ফিরে পাবে। সমস্ত অনিশ্চয়তা এবং ক্লেশের অবসান ঘটবে। কিন্তু আন্দামানে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যে সব খবর হলধররা পেয়েছে। তাতে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছে।
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।