বিশ্বজিৎ রাহা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি আর বাধা দিলেন না।
লক্ষ্মণ একনাগাড়ে একই সুরে বলে যাচ্ছে, ‘নবদ্বীপ ক’ল (বলল) তুই বেবুশ্যার ছাওয়াল (বেশ্যার ছেলে), আমি তোর এইটা করি, হেইটা করি। কত যে অশৈল্য (অশ্লীল) কথা। গালি দিতি দিতি (দিবে দিতে) হে (সে) আমারে মাইরল চোপার (মারল চড়), গ্যালাম পড়ি (পড়ে গেলম)। উইঠে পড়লাম, আবার মাইরল (মারল) চোপার। চোপার খাতি খাতি মনে রাগ হল। জমিনে একখান সরু কইঞ্চি (কঞ্চি) পইড়ে ছিল। সে তুলি নবদ্বীপির কপালে আস্তে করি ঠেহাইচি ঠেকিয়েছি)। উপুরি দেখচি ভগমান, নিচি দেখিচি আফনিরে (আপনাকে)। সব খুইলে ক’লাম (বলাম)। এই বার আফনে (আপনি) আমারি (আমাকে) মারলি মারতে ফারেন (পারেন), কাটলে কাটতি ফারেন। গুলি করি মারতি ফারেন (মারতে পারেন)। টাস করি বাড়ি মারি হাগরের জলে ভাসায়ি (ভাসিয়ে) দিতি ফারেন (পারেন)। গুরু জানে ভগমান জানে, হুজুর আফনির সামনি (আপনার সামনে) সত্য কথাগুলোন কলাম (বললাম)।‘
এতক্ষণে লক্ষ্মণ ভক্ত থামল। বিশ্বজিৎ রাহা তাকে সাত দিন পুলিশের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়ে আজকের মতো আদালতের কাজ স্থগিত করে দিলেন।
অন্যদিন আদালত থেকে রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের নানা দায়িত্ব সামলে বাংলোয় ফিরতে ফিরতে তার রাত সাতটা আটটা বেজে যায়। চিফ কমিশনারের সঙ্গে জরুরি মিটিং টিটিং থাকলে আরও রাত হয়।
আজ আর রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেনেটর অফিসে গেলেন না বিশ্বজিৎ। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে হাসপাতালে যেতে বললেন। নবদ্বীপের খবর নিয়ে খুব সম্ভব বাংলোয় ফিরবেন, বোঝা গেল। না চড়াই-উতরাই ভেঙে ঝকঝকে মডেলের হিন্দুস্থান এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ। ব্যাকসিটে পিঠ হেলিয়ে দিয়ে বসে আছেন বিশ্বজিৎ, পাশে বিনয়। আড়চোখে তাকে একবার দেখে নিল বিনয়। আন্দামানের দোর্দন্ডপ্রতাপ ম্যাজিস্ট্রেটকে বেশ একটু বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। আন্দাজ করা গেল তার কারণ জেফ্রি পয়েন্টের লক্ষ্মণ ভক্ত। একটা আসামী যে একজন বিচারককে এমন কাহিল করে ফেলতে পারে চর্মচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
একসময় সোজা হয়ে বসলেন বিশ্বজিৎ।–’লোকটা কত বড় শয়তান দেখলেন। নবদ্বীপ প্রায় মরতে বসেছিল আর সে কিনা বলে সরু একটা কঞ্চি তার মাথায় ঠেকিয়েছে! তার ওপর আমাকে পর্যন্ত এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে। এত বড় বদমাশ—’
আদালতে বসে থাকতে থাকতে যে ক্রোধ, বিরক্তি, বিরূপতা–সব মিলিয়ে তীব্র উত্তাপ তাঁর মধ্যে জমা হয়েছিল, এতক্ষণে সেটা সশব্দে বেরিয়ে এল।
.
পোর্টব্লেয়ারে আর থাকতে চাইছিল না বিনয়। জেফ্রি পয়েন্ট নামে পাহাড় জঙ্গল সমুদ্রে ঘেরা ছিন্নমূল মানুষদের সেই উপনিবেশটা তার সমস্ত অস্তিত্ব ধরে যেন টানছিল। বেশ কয়েক দিন হল নতুন সেটলমেন্ট থেকে সে এত দূরে এসে আছে। এর মধ্যে লা-পোয়েরা হয়তো জেফ্রি পয়েন্টে চলে এসেছে। তাকে না পেয়ে আবার সমুদ্র থেকে শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাস তোলার জন্য দূরে কোথাও চলে গেছে কিনা কে জানে। তারা যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে মধ্য আন্দামানে যাওয়ার সম্ভাবনাটা অন্তত এবারের মতো বিলীন হয়ে যাবে। কবে মিডল আন্দামানে পৌঁছে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা করতে পারবে, কে জানে। কিভাবে সেই সুযোগ আসবে তাও জানা নেই।
লা-পোয়েদের জন্য ভীষণ ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল বিনয়। ওদের সঙ্গে কথা হয়ে আছে। জেফ্রি পয়েন্টে তাকে না পেলে ওরা কি চলে যাবে? নিশ্চয়ই তার জন্য দু-চারদিন অপেক্ষা করবে। এই আশার সুতোটুকু ধরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে জেফ্রি পয়েন্টে চলে যেতে হবে।
আদালত থেকে ফেরার দু’দিন পর খামে খামে সুধাদের কাছে লেখা চিঠিগুলো আর একটা বড় প্যাকেটে ‘নতুন ভারত’-এর জন্য লেখা পাঁচটা প্রতিবেদন ভরে বিশ্বজিৎকে দিয়ে বিনয় বলল, ‘ওগুলো কাইন্ডলি কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। আর আমাকে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। ওই সেটলমেন্ট আর খানিকটা দূরের পেনাল কলোনি আর উদ্বাস্তুদের আরও ক’টা সেটলমেন্ট সম্পর্কে বেশ কিছু লেখা তৈরি করতে হবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘হা হা, নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি শুধু নিউজ পেপারের রোভিং রিপোর্টার নন, এখানকার রিফিউজি সেটলমেন্টের একজন হয়ে উঠেছেন। নানাভাবে আমাদের সাহায্য করছেন। আপনি জেফ্রি পয়েন্টে গেলে কাকা খুশি তো হবেনই, সেটলমেন্টেরও অনেক উপকার হবে। কবে যেতে চাইছেন?
‘আজ কি অ্যারেঞ্জমেন্ট করা সম্ভব?
ওরা ড্রইংরুমে বসে সকালবেলার চা খাচ্ছিল। ঘড়ি দেখে বিশ্বজিৎ বললেন, এখন আটটা বেজে সতেরো। আজ আর হবে না। কাল ভোরে যান।
‘ঠিক আছে। আমার কিছু বলার ছিল—’
‘বেশ তো, বলুন না—’
‘কিছুদিন আগে আপনাকে জানিয়েছিলাম, শেল কালেক্টারদের নিয়ে আমি একটা লেখা লিখতে চাই। মনে আছে?’
‘আছে আছে। শেল কালেক্টরদের লাইফটা খুব ইন্টারেস্টিং আর ভীষণ বিপজ্জনকও। সমুদ্র থেকে ‘শেল’ ভোলা মুখের কথা নয়। হাঙরেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরছে। কিন্তু ডাইভাররা খুবই সাহসী, হাঙরের সঙ্গে লড়াই করে ‘শেল’ তুলে আনে। এদের নিয়ে লেখা উচিত। মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে কত রকম জীবিকা যে বেছে নিয়েছে!’
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।