কিন্তু চকিতের জন্য সে দিন খিদিরপুরের বাইশ নম্বর ডেকে ঝিনুককে দেখার পর পুরনো ব্যাকুলতা বুকের গভীর স্তর খুঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। জাহাজের খোলে হাজারটা ছিন্নমূল মানুষের ভেতর আতিপাতি করে তার সন্ধান করেছে। বিনয়। না, তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বিনয় ভেবেছে, হয়তো চোখের ভুল, নেহাতই ক্ষণিকের বিভ্রম। হয়তো মুখের আদলে খানিকটা মিল আছে, তাই মনে হয়েছে ঝিনুক। বিনয় নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামানেই যাবে কেন ঝিনুক? কার সঙ্গেই বা যাবে? কলকাতার মতো মহানগরে তার চেনাজানা এমন কেউ নেই যার সঙ্গে সে আন্দামানের জাহাজে উঠতে পারে।
কিন্তু এই কিছুক্ষণ আগে বিনয়ের সব ভ্রান্তি কেটে গেছে। অন্য কেউ নয়, ঝিনুকই ইন্টার আইল্যান্ড সারভিসের ‘‘চলুঙ্গা’ জাহাজে পাঁচশো উদ্বাস্তুর সঙ্গে মিডল আইল্যান্ডে চলে গেল।
কে বলে পুরনো আবেগ মরে যায়? তা-ই যদি হত, হৃৎপিণ্ড এ উথাল পাথাল হচ্ছে কেন? কেনই বা শিরাস্নায়ু ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে? একটা দম-আটকানো কষ্ট ডেলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে গেছে। তারই মধ্যে বিনয় ভাবছিল, যেমন করে তোক মিডল আন্দামানে ঝিনুকের কাছে তাকে যেতেই হবে। কাল হোক, পরশু হোক বা দশ বিশ দিন পরে। ঝিনুকের সঙ্গে দেখা তো করবেই, তাকে না নিয়ে কলকাতায় ফিরবে না। হঠাৎ দূর থেকে ভট ভট শব্দ কানে এল। চমকে বিনয় দেখতে পায়, সেলোস্ট্রেস বে আধখানা বৃত্তের আকারে বেঁকে যেখানে সেলুলার জেলের তলা দিয়ে ডাইনে বহু দূরে চলে গেছে সেখান থেকে দুটো বড় লঞ্চ এদিকে এগিয়ে আসছে।
পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে, ‘বিনয়বাবু, বিনয়বাবু–’’
ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ে–নিরঞ্জন। সে বলল, ‘আপনের মালপত্র গোছগাছ কইরা রেডি হন। লঞ্চ আইতে আছে। এইবার পোর্ট ব্লেয়ার টাউনে যামু—’
মালপত্র আর কী। একটা চামড়ার স্যুটকেস, মাঝারি একটা হোল্ড-অলে তোশক, হাওয়া বালিশ, কম্বল, চাদর আর মশারি গুছিয়ে বেঁধে দিয়েছে ‘শান্তিনিবাস’ মেসের সুবল। সেগুলো গার্ডেন আমব্রেলা ধরনের মস্ত একটা ছাতার তলায় একধারে রেখে দিয়েছে বিনয়। সে অন্যমনস্কর মতো পা ফেলে ফেলে তেজি বোদ ঠেকাতে যেখানে গার্ডেন আমব্রেলাগুলো ডানা মেলে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গেল।
এদিকে বিভাস এবং উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের চার পাঁচজন কর্মী মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শরণার্থীদের সমানে তাড়া দিচ্ছিল। পোর্ট ব্লেয়ার যেতে হবে। পনেরো কুড়ি মিনিটের ভেতর সবাই যেন প্রস্তুত হয়ে নেয়। নিরঞ্জন বিনয়কে যা বলেছে, বিভাসরা ঠিক তা-ই বলছে উদ্বাস্তুদের।
কলকাতা থেকে আসার পথে: সমুদ্রে সাইক্লোনের মুখে পড়েছিল কিনয়দের জাহাজ ‘এস এস মহারাজা’। তুমুল রোলিং জাহাজের খোলে হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে অবিরল একবার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে, পরক্ষণে নিচে আছড়ে ফেলে, দুমড়ে মুচড়ে তাদের শরীরগুলোকে ময়দা ঠাসার মতো তালগোল পাকিয়ে ছেড়েছিল। যা খেয়েছিল পাকস্থলী থেকে হড়হড় করে বমি হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। পরে সমুদ্র শান্ত হলেও তারা এতটাই কাহিল হয়ে পড়ে যে খাওয়ার কোনওরকম ইচ্ছাই ছিল না; বাঙ্কে চোখ বুজে নির্জীব শুয়ে থেকেছে তারা।
কিন্তু ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছবার পর পায়ের তলায় মাটি পেয়ে খিদেটা ফের ফিরে আসে। পেট জ্বলে যাচ্ছিল তাদের। যেন দাউদাউ আগুন জ্বলছে। জাহাজেই চানটান সেরে নিয়েছিল। ‘রস’-এ নেমে ভাত ডাল মাছ তরকারি দিয়ে গলা অবধি ঠেসে তবে শান্তি। খাওয়াদাওয়া চুকলে ভালো করে যে জিরিয়ে নেবে তেমন ফুরসত পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ছ’ ছ’টা বিয়ে হল। তারপর শ’ পাঁচেক উদ্বাস্তু তুলে নিয়ে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজ মিডল আন্দামানে চলে গেল। বাকি যারা রইল, এতসব ঘটনার পর অপার ক্লান্তিতে তাদের চোখ জুড়ে এসেছে। ঝাড়ালো প্যাডক কি চুগলুম গাছের ছায়ায়, কিংবা বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে-যে যেখানে পেরেছে, শুয়ে পড়েছে।
বিভাসদের হাঁকাহাঁকিতে তারা ধড়মড় করে উঠে বসে। তারপর কলকাতার রিলিফ ক্যাম্পগুলো থেকে পার্থিব সম্পত্তি বলতে–টিনের বেড়ানো বাক্স, কথাকানি, ছেঁড়া শতরঞ্চিতে জড়ানো বিছানা, হাতা খুন্তি কড়াই যে যেটুকু পেরেছে নিয়ে এসেছে, সব জড়ো করে নিল।
এদিকে উপসাগরের জল তোলপাড় করে, গম্ভীর ভো বাজিয়ে সেই লঞ্চ দুটো রস আইল্যান্ডের জেটিতে এসে ভিড়ল। দুই লঞ্চেরই খালাসিরা লোহার শেকল দিয়ে জলযান দুটোকে জেটির মোটা মোটা লোহার থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর রেলিং লাগানো চওড়া কাঠের পাটাতন ফেলে লঞ্চের সঙ্গে জেটি জুড়ে দিল। এই ছোট পুল দিয়ে লঞ্চে উঠতে হবে।
বিভাস, নিরঞ্জন এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ছেলেরা দারুণ করিৎকর্মা। হাতে পায়ে তাদের যেন বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। ছোটাছুটি এবং হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের জেটির কাছে জড়ো করে একে একে তাদের লঞ্চে তুলতে লাগল। সমস্ত কাজটার মধ্যে রয়েছে নিখুঁত শৃঙ্খলা।
একটা লঞ্চ বোঝাই হয়ে গেলে বিভাস সেটায় উঠে পড়ে। লঞ্চটার নাম ‘সিগাল’। ‘সিগাল’ আর দাঁড়াল না, জল কেটে কেটে পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে চলে গেল।
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।