ভয়ে ভয়ে সুবর্ণা বলে, দেখুন, উনি প্রায় বেড-রিডন–’
এই ইনফরমেশনটা আমার কাছে নতুন নয়। আগেও দু-একবার বলেছেন, তাঁর বার কয়েক হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে–এই তো?
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব বলে, এই টাইপের পেশেন্টদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করতে হয় আমার জানা আছে। আপনার প্রবলেম যাতে না হয় সেটা মাথায় রাখতে চেষ্টা করব। একটু থেমে বলে, তবে একটা পয়েন্ট ক্লিয়ার করে দিই। আমার ধৈর্য কিন্তু খুব কম।
সুবর্ণা প্রায় একটি ঘণ্টা এই মারাত্মক লোকটার সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছে। এ তো বন্ধুদের সঙ্গে হালকা মেজাজে আড্ডা দেওয়ার মতো আনন্দের ব্যাপার নয়। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে রাখতে হয়েছে, কোনওরকম হঠকারিতা করা চলবে না। দাবার চতুর চাল দেবার ভঙ্গিতে রাজীবের সঙ্গে অঘোষিত একটা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে সে। ক্রমাগত উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় যে পায়নি তা নয়। অসীম মনোবলে লোকটার মুখোমুখি নিজেকে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে। রেখেছে। কিন্তু টান টান স্নায়ুগুলো এবার কেমন যেন আলগা হয়ে আসছে। রাজীব বলেছে তার ধৈর্য কম। ওদিকে শ্বশুরমশাই অসম্ভব বদরাগী, তার পছন্দমতো কিছু না হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়েন। এর পরিণতি কী ঘটতে পারে সেটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না সুবর্ণার, আর সেই কারণে মনে হয় সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। কিন্তু না, যুদ্ধের তো সবে শুরু। প্রথম রাউন্ডটা এখনও শেষ হয়নি। এরপর কতদিন ধরে লড়াইটা চলতে থাকবে, কে জানে। যতদিনই চলুক, তার ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজের ভেতরকার শক্তিকে অটুট রেখে অনবরত রণকৌশল ঠিক করে যেতে হবে।
রাজীব এবার বলে, চলুন, দোতলায় গিয়ে আপনার শ্বশুরমশাইদের দেখা যাক।
ঝাপসা গলায় সুবর্ণা বলে, আসুন–
হল-ঘরে ফিরে এসে কাঠের সেই অর্ধবৃত্তাকার সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে আগে আগে উঠতে থাকে সুবর্ণা আর দেবী। তাদের পেছন পেছন অনিবার্য নিয়তির মতো রাজীব। হঠাৎ থমকে ঘুরে দাঁড়ায় সুবর্ণা। অগত্যা রাজীবকেও থামতে হয়। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হল?
শ্বশুরমশাই যদি জানতে চান, আপনাকে এ বাড়িতে থাকতে দিচ্ছি কেন? তাকে কি বলব আপনি জোর করে থাকতে চাইছেন, তাই বাধ্য হয়ে–
না।
আপনার থাকার কারণটা কী বলব, বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলে দেবেন?
এই প্রথম একটু থতিয়ে যায় রাজীব। খানিকক্ষণ ভেবে বলে, বলবেন আমি আপনার আত্মীয়। মামাতো ভাই, পিসতুতো ভাই, কাকা, মেসোর শালা–এনি ড্যাম থিং বলতে পারেন। বহুদিন বাইরে-কঙ্গো, ঘানা, আমস্টারডাম, সিয়েরা লিওন, বুরকিনা ফাসো কি প্যারাগুয়েতে ছিলাম। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ খোঁজ পেয়ে চলে এসেছি।
অদ্ভুত চোখে খুব আস্তে আস্তে রাজীবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে থাকে সুবর্ণা।
রাজীব এভাবে তার তাকানোর উদ্দেশ্যটা বুঝে নিয়ে বলে, আমাকে অবশ্য আপনার আত্মীয় বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার যা চেহারা তাতে হার্ড-ফিচারড অ্যান্টিসোশাল বলে মনে হবে। এনিওয়ে, আমার ব্যাগে শেভিং সেট আর পরিষ্কার দু-একটা জামাপ্যান্ট আছে। শেভ টেভ করে পোশাক চেঞ্জ করলে খানিকটা ভদ্র দেখাতে পারে। হঠাৎ কী খেয়াল হতে চিন্তিতভাবে বলে, কিন্তু
সুবর্ণা উত্তর দেয় না। স্থির চোখে রাজীবকে লক্ষ করতে থাকে। রাজীব বলে, আপনার আত্মীয়স্বজন, মানে আপনার বাপের বাড়ির দিকের রিলেটিভরা এ বাড়িতে এলে তাদের চোখে ধূলো দেওয়া যাবে না তখন ঝাট হতে পারে।
সুবর্ণা বলে, আমার মা-বাবা নেই। একমাত্র দাদা থাকে দিল্লিতে। বছরে একবার এসে আমাকে দেখে যায়। মাস দুই আগে এসেছিল, ফের আসবে নেক্সট ইয়ারে।
অন্য রিলেটিভরা?’
আমার শ্বশুরমশাই তাদের একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই তাদের এ বাড়িতে যাতায়াত নেই।
লোকটার নিজের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। সুবর্ণার বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনরা এখানে আসে না, কাজেই তার ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই। এতে সে খুশি। তার চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তির ছাপ ফুটে বেরোয়। বলে, ঠিক আছে, ওপরে যাওয়া যাক।
যন্ত্রচালিতের মতো ফের আগে আগে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে সুবর্ণা আর দেবী। তাদের দু’ধাপ পেছনে রাজীব। আচ্ছাদনহীন কাঠের সিঁড়িতে তিন জোড়া নানা ধরনের জুতোর ভারী এবং হালকা আওয়াজ ছাড়া এ বাড়িতে এখন আর কোনও শব্দ নেই।
দোতলার নকশাটা হুবহু একতলার মতোই। তেমনই বিশাল হল-ঘরের তিন দিক ঘিরে লাইন দিয়ে ঘর। তবে সবগুলোই কিন্তু বেড র নয়। একটা ঘরকে কিচেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
নিচের তুলনায় ওপরে আলোটালো অনেক বেশি। চারিদিক পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে। একতলার মতো সিলিং থেকে এখানেও একটা বিশাল ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, সেটা অবশ্য জ্বলছে না। নিচে একটা ছাড়া বাকি ঘরগুলোতে তালা লাগানো। এখানে সবগুলো ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে, দরজাও খোলা। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরেই এখানে লোকজন থাকে।
নিচের কার্পেটটা ছিঁড়ে খুঁড়ে সামান্যই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু দোতলার হল-ঘরে যেটা পাতা রয়েছে সেটা বহুদিনের পুরনো, রংও নষ্ট হয়ে গেছে, তবু তার হাল নিচেরটার মতো অত খারাপ নয়। মোটামুটি অটুটই আছে বলা যায়।