তার মনোভাব আন্দাজ করে নেয় রাজীব। বলে, এ বাড়ির ঠিক কোন জায়গাটা আমার পক্ষে সবচেয়ে সেফ সেটা দেখে নিতে হবে না? এ কী, আর বসে থাকবেন না। উঠুন–
দেবীকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুবর্ণা। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা চলছিলই। সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
চেয়ারে বসার আগে কাঁধ থেকে ঢাউস ব্যাগ আর লম্বাটে বাক্সটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিল রাজীব। সে দু’টো ফের তুলে নিয়ে উঠে পড়ে সে।
.
০৩.
একতলার হল-ঘর এবং সেটাকে ঘিরে যে বেডরুমগুলো রয়েছে, আগেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। ডানধারের শেষ ঘরটার পাশ দিয়ে একটা চওড়া প্যাসেজ সোজা যেখানে গিয়ে ঠেকেছে সেটা একটা দরজা। সেখানে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছিল। বাটার ওপর ধুলোময়লা জমেছে। ফলে যে ম্যাড়মেড়ে আলোটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতে কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়, সব কেমন যেন ঝাপসামতো।
দরজাটা দেখে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল রাজীবের। জিজ্ঞেস করে, আপনাদের বাড়িতে ঢোকার জন্যে তা হলে দু’টো দরজা?’
সুবর্ণা আর দেবী রাজীবের পাশাপাশি আসছিল। সুবর্ণা মাথাটা সামান্য হেলিয়ে বলে, হ্যাঁ।
আগে তো বলেননি।
আপনি কি জিজ্ঞেস করেছিলেন?
অল্প একটু থতিয়ে যায় রাজীব। তার একটু ভুল বা বোকামিই হয়ে গেছে। গোগাড়া থেকে সে শাসিয়ে আসছিল, তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া বাড়তি কথা যেন না বলে সুবর্ণা। এ বাড়িতে যে দু’দিক দিয়ে ঢোকা যায়, আগে সেটা তার মাথায় আসেনি। সুবর্ণার কথার জবাব না দিয়ে সে জানতে চায়, দরজার ওধারে কী আছে?
সুবর্ণা বলে, ওপাশটা বাড়ির পেছন দিক। দেখবেন?
হ্যাঁ। রাজীব দরজাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের হাতে খিল খুলে ফেলে। চৌকাঠের ওধার থেকে শ্বেতপাথরের নিচু সিঁড়ি নেমে গেছে। স্টেপগুলোর একটা পাথরও অক্ষত নেই–সব ফাটা, ভাঙা। সিঁড়ির তলা থেকে কঁকা জমি। কুয়াশা আর অন্ধকারে কিছুই প্রায় চোখে পড়ে না। তবু বোঝা যায়। বাউন্ডারি ওয়ালের গা ঘেঁষে টালির শেড-দেওয়া টানা অনেকগুলো ঘর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, এদিকে আলো টালো আছে?
সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, এ বাড়ি তার পক্ষে কতটা নিরাপদ সেটা যাচাই করে নিতে চাইছে রাজীব। সে বলে, একটা ছিল। ক’দিন আগে খারাপ হয়ে গেছে। পালটানো হয়নি।
ওই ঘরগুলোতে কারা থাকে?
কেউ না। এক সময় অবশ্য ড্রাইভার, বেয়ারা, চাকর বাকর মিলিয়ে ষোল সতেরজন কাজের লোক থাকত। পাশেই বিরাট গ্যারেজ। সেখানে থাকত পাঁচ ছ’টা দামি গাড়ি। এখন দু’টো ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে, কোনও কাজে লাগে। না। আনইউজেবল। একটা অবশ্য চলে; তবে সেটার হালও ভাল নয়–
দরজাটা বন্ধ করতে করতে হঠাৎ এই বিশাল বাড়ি, তার পরিবেশ এবং সুবর্ণার একটু আগের কথাগুলো রাজীবকে কিছু একটা মনে করিয়ে দেয়। খিল লাগিয়ে; ঘুরে দাঁড়িয়ে সামান্য হালকা গলায় সে বলে, আমি কি কোনও পুরনো রাজা-মহারাজার বাড়িতে ঢুকে পড়েছি?
সুবর্ণা বলে, ঠিক তাই।
বেশ অবাক হয়ে সুবর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত এক পলক দ্রুত দেখে নেয় রাজীব। সে কিছু বলার আগে সুবর্ণা ফের বলে, এটা রাজবাড়িই। প্যালেস। যদিও ইন্ডিপেনডেন্সের পর রাজতন্ত্রের আর অস্তিত্ব নেই।
রাজীব বলে, জানা রইল। গ্রাউন্ড ফ্লোর দেখা হয়ে গেছে। এবার দোতলায় যাওয়া যাক।
পা বাড়াতে গিয়ে থমকে যায় সুবর্ণা। ভয়ে ভয়ে বলে, দোতলায় আমরা থাকি। সেখানে আপনাকে একটা ইঙ্গিত দিয়ে চুপ করে যায় সে।
এক দৃষ্টে তাকে লক্ষ করছিল রাজীব। বলল, প্রাইভেসির কথা বলছেন?
সুবর্ণা জবাব দেয় না।
রাজীব বলে, আমার সঙ্গে কিছু ডেডলি ওয়েপন আছে। তার একটা আপনি দেখেছেন। আপনাকে জানিয়ে রাখি এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার অনেকগুলো হিউম্যান ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে। বিউটিফুল ইয়ং উইমেন দেখলে পুরুষের যে গ্ল্যান্ডগুলো এক্সাইটেড হয়ে ওঠে, আমার সেই গ্ল্যান্ড মরে, শুকিয়ে গেছে। একেবারে স্টোনডেড। আমার আর ঠান্ডা পাথরের মধ্যে কোনো ডিফারেন্স নেই।
সুবর্ণা বলে, আমি সে কথা বলছি না।
তবে?
সুবর্ণা স্পষ্টাস্পষ্টি না বললেও বুঝিয়ে দেয় দোতলায় দেবী, সে এবং মায়া ছাড়া স্মৃতিভ্রষ্ট দাদাশ্বশুর এবং শয্যাশায়ী শ্বশুরমশাই রয়েছেন। রাজতন্ত্র কবেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তাদের শিরায় শিরায় রাজরক্ত এখনও বয়ে চলেছে। অনেক কিছুই তারা হারিয়েছেন কিন্তু পুরনো দিনের রাজকীয় রুচি, মেজাজ এবং দাম্ভিকতার রেশ তাঁদের অস্তিত্বের মধ্যে তলানির মতো থেকে গেছে। নিজেদের পারিবারিক কোড অফ কনডাক্ট প্রতাপপুর রাজবংশ বহু কাল আগে তৈরি করে নিয়েছিল। তার অনেকগুলো আজও টিকে আছে। বাড়ির অন্তঃপুর সম্পর্কে এঁরা ভীষণ রক্ষণশীল এবং স্পর্শকাতর। সেখানে অচেনা, উটকো কোনও লোককে নিয়ে গেলে প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি হবে। দাদাশ্বশুরের বোধবুদ্ধি কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। পূর্বপুরুষের তৈরি যাবতীয় পারিবারিক রীতি-নীতি ধ্যান-ধারণা তিনি যখের মতো আগলে আছেন। রাজীবকে দোতলায় দেখলে খুবই অসন্তুষ্ট হবেন।
রাজীব ঠান্ডা গলায় বলে, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।