দেবী দারুণ বুদ্ধিমতী। হাসিমুখে খুব নরম গলায় বললেও যার সঙ্গে পিস্তলের মতো একটা মারণাস্ত্র রয়েছে তার কথা সারাক্ষণ, অন্তত যে কদিন রাজীব ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আছে সেটা যে মাথায় রাখতে হবে তা সে ভাল করেই জানে। নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে দেয় দেবী।
আদরের ভঙ্গিতে তার গালে আঙুল ছুঁইয়ে রাজীব বলে, ফাইন। পরক্ষণে তার চোখ সুবর্ণার দিকে ফিরে আসে। বলে, আপনার সম্বন্ধে কিছুই আমার জানা নেই। আপনাকে বেরুতে হয় কেন?
কোনও মানুষ সারাদিন একটা বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে পারে?
ধরুন, ভীষণ অসুস্থ হয়ে আপনি স্যানাটোরিয়ামে এসেছেন। আপনার ঘরের বাইরে যাওয়া বারণ।
সেটা কি আপনার সুবিধার জন্যে?’ নিজের অজান্তে সুবর্ণার মুখ ফসকে কথাগুলো বেরিয়ে আসে।
রাজীব কিন্তু রেগে যায় না। শান্ত গলায় বলে, এজাক্টলি।
কিন্তু–
বলুন—
আমি একটা কলেজে পড়াই। বাড়ি থেকে না বেরুলে ক্লাস নেব কী করে?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাজীব। ভুরুদু’টো ক্রমশ কুঁচকে যেতে থাকে। এক সময় বলে, ইটস আ প্রবলেম। কয়েকটা দিন আপনি ছুটি নিন।
সুবর্ণা বলে, কী করে নেব? আমার ডিপার্টমেন্টে সবসুদ্ধ তিনজন টিচার। একজন ছুটিতে আছেন। আরেকজনের অপারেশন হবে। তিনি কলকাতায় গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন। আমাকে একা ডিপার্টমেন্ট চালাতে হচ্ছে।
রাজীব উত্তর না দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করে সুবর্ণা তাকে ধোঁকা দিতে চাইছে কিনা।
সুবর্ণা ফের বলে, আমি কলেজে না গিয়ে যদি বাড়ি বসে থাকি, প্রিন্সিপ্যাল লোক পাঠাবেন। যদি বলি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি, সারা কলেজ আমাকে দেখার জন্যে ছুটে আসবে।
রাজীবের মুখচোখের চেহারা মুহূর্তে পালটে যায়। যে হিংস্র, উগ্র ভাবটা অল্পক্ষণের জন্য সে লুকিয়ে রেখেছিল সেটা চামড়ার তলা থেকে ফের বেরিয়ে আসে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেষ্টা করবেন না মিসেস সিংহ।
সুবর্ণা বুঝতে পারে, তার কথার একটি বর্ণও বিশ্বাস করেনি রাজীব। হয়তো ভেবে নিয়েছে, বাইরে গিয়ে তোকজন জুটিয়ে, থানায় খবর দিয়ে সে তাকে ফাঁদে ফেলবে। সুবর্ণা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সামনের দিকে ঝুঁকে শ্বাস-টানা গলায় বলে, আপনাকে আগেও বলেছি আমি মিথ্যে বলি না। ইচ্ছে হলে আমাদের। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে পারেন, আমার একজন কলিগ। কলকাতায় গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন কিনা; আরেক জন
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় রাজীব। ধীরে ধীরে তার মুখের হিংস্রতা মুছে যেতে থাকে। হয়তো সুবর্ণার কথা বিশ্বাস করেছে। বলে, আপনাদের বাড়িতে টেলিফোন আছে?
আছে।
সেটা কোথায় থাকে?
আমার বেডরুমে।
রাজীব কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় বাইরের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা যায়। সেই সঙ্গে কেউ গলা উঁচুতে তুলে ডাকছে, দেবী দিদি–দেবী দিদি-মায়া–এ সময় দরজা বন্ধ করল কে?
রাজীব চমকে উঠেছিল। সে বুঝতে পারছে, এই সন্ধেবেলাটা বাইরের দরজা খোলা থাকে। সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, কে ডাকছে?
সুবর্ণা বলে, হরেন। কী বলব ওকে?
দ্রুত কিছু ভেবে নিয়েছিল রাজীব। বলে, ওকে দু’ঘন্টা পর আসতে বলুন।
সুবর্ণা আপত্তি করে না। করেও লাভ নেই। চেয়ারে বসেই যান্ত্রিক নিয়মে রাজীবের শোনানো কথাগুলো আওড়ে যায়।
হরেন দরজার বাইরে থেকে একটু অবাক হয়েই যেন বলে, দু’ঘণ্টা পরে কেন বৌদিদি? বাড়িতে ঢের কাজ পড়ে রয়েছে যে–
সুবর্ণা বলে, তোমাকে যা বলছি তাই করো।
ঠিক আছে বৌদিদি।
এরপর আর হরেনের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। খুব সম্ভব দু’ঘণ্টার জন্য সে শহরের দিকে চলে গেছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ।
তারপর রাজীব বলে, আপনাকে যখন কলেজে যেতেই হবে তখন আর জোর করে আটকাব না। কিন্তু দেবীকে যা বলেছি সেটা আপনাকেও সবসময় মনে রাখতে হবে। আমার কথা কাউকে বলা চলবে না।
সুবর্ণা উত্তর দেয় না। ভাবতে চেষ্টা করে, এই হুঁশিয়ারিটা রাজীব আগেও দিয়েছিল কিনা।
রাজীব বলে, আপনাদের একজন কাজের মেয়ের কথা বলেছিলেন না–
হ্যাঁ, মায়া।
সে কি বাড়ির বাইরে বেরোয়?
প্রশ্নটার পেছনে যে উদ্দেশ্যটা রয়েছে সেটা খুবই পরিষ্কার। মায়া বাইরে বেরুলে রাজীবের এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকার খবর চারিদিকে চাউর হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই সব দিক থেকে সে সতর্ক থাকতে চায়। সুবর্ণা বলে, না। ওর বেরুবার দরকার হয় না। তবে–
রাজীব বলে, তবে কী?
মায়ার এক ভাইপো এই শহরেই থাকে। দু উইক পরপর সে তাকে দেখতে যায়। সকালে যায়, সন্ধের আগে আগে ফিরে আসে।
এ বাড়িতে ভিজিটর টিজিটর কেমন আসে? খুব বেশি কি?
বেশি না হলেও কিছু তো আসেই। ছুটির দিনে দেবীর বন্ধুরা কেউ না কেউ এসে সারাদিন কাটিয়ে যায়। আমার কলিগরাও আসে। আর
সুবর্ণার কথা শেষ হতে না হতে রাজীব বলে ওঠে, আর কে?
সুবর্ণা বলে, আমি একটা উইমেন্স ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত। ওর মেম্বাররা অনেকেই মাঝে মাঝে নানা ব্যাপারে আসে।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করে না রাজীব। শুধু বলে, এবার চলুন, আপনাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখাবেন।
কেন রাজীব বাড়ি দেখতে চাইছে, বুঝতে না পেরে দ্বিধান্বিতভাবে তাকিয়ে থাকে সুবর্ণা। তবে কিছু জিজ্ঞেস করে না।