লোকটা কয়েক পলক কী চিন্তা করে বলে, সেটা পরে ভেবে বলব।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
লোকটা বলে, এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? আপনার মেয়ের কষ্ট হচ্ছে। চলুন কোথাও বসা যাক। এমনভাবে কথাগুলো সে বলল যেন এ বাড়িটা তার খাস তালুক, সুবর্ণা মেয়েকে নিয়ে এখানে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
এই মারাত্মক, সশস্ত্র লোকটাকে দোতলায় নিয়ে যাওয়া যায় না। এদিক সেদিক তাকিয়ে হল-ঘরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণা বলে, আসুন, ওখানে যাই।
দেবীর পড়াশোনার জন্য যে চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে সেখানে গিয়ে লোকটাকে বসায় সুবর্ণা। দেবী আর সে তার মুখোমুখি বসে।
লোকটা বলে, আপনার নামটা জানতে পারলে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হত।
সুবর্ণা তার নাম জানিয়ে দিয়ে বলে, আপনার পরিচয়ও কিন্তু এখন পর্যন্ত জানান নি।
চোখ কুঁচকে কী ভেবে নেয় লোকটা। তারপর বলে, আমার নাম রাজীব।
লোকটা যে সঠিক নাম জানায়নি সেটা তার মুখের চেহারা এবং বলার ভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। এই গোপনতার কারণ কী? তার হাতে পিস্তল টিস্তল দেখে সুবর্ণার স্নায়ুমণ্ডলীতে এমন চাপ পড়েছে যে মাথার ভেতর সব কিছু গুলিয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ তার মনে পড়ে, এই লোকটা হল-ঘরে ঢোকার আগে সে রাস্তায় অস্পষ্টভাবে হইচই এবং পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। লোকটা কি পলাতক কোনও আসামী? যার চেহারা এমন উগ্র, ভয়ানক মারণাস্ত্র নিয়ে যে জোর করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়ে তার পক্ষে দু-চারটে খুন টুন করে আসা অসম্ভব নয়। একটা নৃশংস হত্যাকারী তাদের ঘাড়ের ওপর কতদিন চেপে বসে থাকবে কে জানে। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে তাকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানো যায় তা-ই বা কে বলে দেবে! ক্ষীণ গলায় সুবর্ণা শুধু বলে, রাজীব কী?’ সারনেম বা পদবিটা জানতে পারলে নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার কোন অঞ্চলের মানুষ সেটা বোঝা যেত।
লোকটা কিন্তু সেদিক দিয়েই গেল না। বলল, ডাকাডাকি, কথা বলা–এ সব কাজ চালিয়ে নেবার জন্যে রাজীব নামটাই যথেষ্ট। সারনেমের কী প্রয়োজন?
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না সুবর্ণার।
লোকটা অর্থাৎ রাজীব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হল-ঘরের চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একবার দেখে নেয়। যেদিকটায় দরজা, সেটা ছাড়া অন্য তিন ধারে হল-ঘরটা ঘিরে সবসুদ্ধ পাঁচটা বেডরুম, যার চারটেতেই ঢাউস ঢাউস তালা লাগানো। তালাগুলোতে মরচে ধরে গেছে। বহুকাল যে ওগুলো ব্যবহার করা হয় না, সেটা বলে না দিলেও চলে। তবে ডান পাশের শেষ ঘরটায় তালা নেই; বাইরে থেকে পাল্লা দু’টো টেনে বন্ধ করা। দরজাটা মোটামুটি পরিষ্কার। বোঝা যায়, ওই ঘরটায় কেউ থাকে।
রাজীব বলে, আমার কয়েকটা ইনফরমেশন দরকার মিসেস সিংহ।
সুবর্ণা বলে, কী জানতে চান বলুন।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনি হরেন নামে একটা লোকের কথা বলেছিলেন। সে আপনাদের গেটকিপার ছাড়া আরও কী কী যেন করে। লোকটা কি এ বাড়িতে থাকে?
হ্যাঁ। যে ঘরটায় তালা নেই সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণা বলে, ওখানে—
আমি যে ক’দিন থাকব, হরেনকে ছুটি দিন।
সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। বলে, তা কী করে সম্ভব?
রাজীব রুক্ষ গলায় বলে, মিসেস সিংহ আপনাকে আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম, আমি যা বলব চুপচাপ তাই করবেন। কোনওরকম প্রোটেস্ট বা বিরুদ্ধতা করবেন না। আমাকে যেন আর তা মনে করিয়ে দিতে না হয়। একটু থেমে কী ভেবে জিজ্ঞেস করে, হরেনকে ছুটি দেওয়া সম্ভব নয় কেন?
সুবর্ণা অনুনয়ের সুরে বলে, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আওয়ার ফ্যামিলি প্রবলেম। আমার শ্বশুর হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্ট; দাদাশ্বশুরের মেমোরি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব আপনাকে জানিয়েছি। ডাক্তার ডাকা, ওষুধ কেনা, বাজার করা, গেট পাহারা দেওয়া থেকে অনেক কিছুই হরেন করে থাকে। ওকে ছাড়া আমাদের ফ্যামিলি একেবারে অচল। এই অবস্থায়–’বলতে বলতে চুপ করে যায় সে।
সুবর্ণাদের পারিবারিক সমস্যাগুলো হয়তো রাজীবকে সামান্য নাড়া দেয়। সে বলে, হরেন থাকতে পারে একটা কন্ডিশনে–
কী কন্ডিশন?
আমার কথা তাকে বলা চলবে না। আর—
আর কী?
তার সঙ্গে আমার কোনওভাবেই দেখা হওয়া চলবে না।
সুবর্ণা বলে ইমপসিবল!’
রাজীবের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে ওঠে। সে বলে, ইমপসিবল কেন?’
সুবর্ণা বুঝিয়ে দেয়, রাজীব এ বাড়িতে থাকলে একতলার এই হল-ঘরের তিন দিকে যে তালাবন্ধ ঘরগুলো রয়েছে তার একটা খুলে সাফ টাফ করে বাসযোগ্য করে দেওয়া হবে। আর এই একতলাতেই হরেন থাকে। তার সঙ্গে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে রাজীবের দেখা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
রাজীব মুখ নামিয়ে কিছুক্ষণ কী চিন্তা করে। তারপর বলে, আমি কোথায় থাকব, পরে ঠিক করব।
লোকটা হাবেভাবে কথায়বার্তায় প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে-ই যেন এই ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর মালিক। এ বাড়ির কোথায় কোন অংশে রাজীব থাকবে সেটা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সুবর্ণার মতামতের তোয়াক্কা করাটা সে প্রয়োজন বোধ করে না।
সুবর্ণা কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। বিমূঢ়ের মতো শুধু তাকিয়ে থাকে।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, হরেন ছাড়া এ বাড়ির আর কাকে কাকে বাইরে বেরুতে হয়?
সুবর্ণা বলে, আমাকে আর দেবীকে।
কী ভেবে রাজীব বলে, দেবীর স্কুল থাকে। তাকে তো বেরুতেই হবে। দেবীর দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলে, ইউ আর আ গুড গার্ল। আমি তোমার আঙ্কল। ক’দিন তোমাদের কাছে থাকব। আমি যে এখানে আছি সেটা বাইরের কাউকে, এমনকি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকেও জানাবে না। কথাটা মনে থাকবে?