সকালের দিকে ততটা সময় পায় না সুবর্ণা। কিন্তু বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে সংগ্রামনারায়ণ, দেবী আর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়ার ব্যবস্থা করে, দেবীকে পড়তে বসিয়ে নীচে নেমে আসে। বিকেলে চা খাবার টাবার সে একতলায় রাজীব এবং আশ্রিতা মহিলাদের সঙ্গে বসে খায়। তারপর কাজ শুরু হয়ে যায়। রাজীব আর সে নানাভাবে মহিলাগুলোকে আনন্দে রাখতে চেষ্টা করে।
যা সুবর্ণার বলার কথা, মাঝে মাঝে সেটাই বলে ফেলে রাজীব, মিসেস সিংহ, আপনার শ্বশুর আপনাকে একদিন চরম অপমান করেছে। আপনার হাজব্যান্ড জঘন্যভাবে বিট্রে করেছে। জীবনে অলমোস্ট কিছুই পাননি। আপনার মধ্যে রাগ ছাড়া আর কিছুই থাকার কথা নয়। তবু মানুষের জন্যে এত মায়া রয়েছে কী করে?
সুবর্ণা সামান্য হেঁসে বলে, এটা তো আমিও আপনার সম্বন্ধে বলতে পারি।’
একটু হকচকিয়ে যায় রাজীব। বলে, কীরকম?
উত্তর না দিয়ে সুবর্ণা যেন দূরমনস্কর মতো বলে যায়, আসলে এ এমন এক দেশ, যতই ঘৃণা বা ক্ষোভ থাক, কেউ বোধহয় কাউকে ফেলে চলে যেতে পারে না। অদৃশ্য এক বন্ধন তাদের জড়িয়ে ধরে রাখে। একটু থেমে বলে, করুণা, মমতা, উদারতা, যাই বলুন এটাই ভারতবর্ষের আসল দিক।
রাজীব উত্তর দেয় না।
.
মহিলারা আসার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে।
তারপর একদিন মাঝরাতে নিচে প্রচণ্ড হইচই শুনে দোতলা থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে নেমে এল সুবর্ণা।
হল-ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রাজীব, তার হাতে হ্যান্ড-কাফ। তাকে ঘিরে রয়েছে দশ পনেরো জন আর্মড পুলিশ। প্রতাপপুর থানার ওসি রামেশ্বর বসাক এবং পারুল দে-কে একধারে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অপ্রকৃতিস্থ, খ্যাপাটে পারুল এখন আশ্চর্য রকমের স্বাভাবিক। অন্য মহিলারা পুলিশ দেখে ভয়ে, আতঙ্কে ঘরে খিল দিয়ে চেঁচামেচি করছে। নমিতা, তাপসী এবং হরেন। বিহ্বলের মতো রামেশ্বরদের দেখছে।
স্তম্ভিত সুবর্ণা সিঁড়ির তলায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার দিকে নজর পড়তে এগিয়ে এলেন রামেশ্বর। বললেন, মিসেস সিংহ, আমার প্রথম থেকেই ধারণা ছিল ওই মিলিটান্টটা প্রতাপপুর প্যানে’-এ শেলটার নিয়ে আপনাদের হোস্টেজ করে রেখেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। পারুলকে দেখিয়ে বললেন, তাই আমাদের এই অফিসারটিকে নন-ক্রিমিনাল লুনাটিকদের সঙ্গে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। সামনের দিকের দরজায় সারাক্ষণ তালা লাগানো থাকে কিন্তু মিলিটান্টটা পেছন দিকের দরজার কথাটা মাথায় রাখেনি। কিছুক্ষণ আগে পারুল দে ওটা খুলে দিয়েছিল। তখন মিলিটান্টটা ঘুমোচ্ছে। পাঁচ মিনিটের ভেতর আমাদের কাজ শেষ করলাম। একেবারে পিসফুল, ব্লাডলেস অপারেশন। একটা গুলিও খরচ হয়নি।’ বলে সগর্বে হাসলেন!
সুবর্ণা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলে না।
রামেশ্বর এবার জিজ্ঞেস করলেন, ওর জিনিসপত্র, মানে ব্যাগ বা সুটকেশ টুটকেশ কোথায়? আমার বিশ্বাস, সেগুলোর ভেতর প্রচুর ওয়েপন পাওয়া যাবে।
ধীরে ধীরে অসাড় একটা আঙুল তুলে দোতলাটা দেখিয়ে দিল সুবর্ণা।
রামেশ্বর বললেন, দোতলার কোথায়?
কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলল, বাঁ দিকের শেষ বেডরুমটায়; আমার দাদাশ্বশুর যেখানে থাকেন।
রামেশ্বর একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই ওপরে উঠে গেলেন এবং রাজীবের সেই ঢাউস ব্যাগ এবং বাদ্যযন্ত্র রাখার মতো লম্বা খাপটা নিয়ে এসে বললেন, মিসেস সিংহ, এত রাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। বুঝতেই পারছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুলিশকে অনেক অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হয়। আচ্ছা চলি, নমস্কার–
রামেশ্বররা রাজবাড়িতে ঢুকেছিলেন পেছনের দরজা দিয়ে, বেরুলেন সামনে দিয়ে।
নিজের অজান্তেই তাদের সঙ্গে নিঃশব্দে দরজার কাছে চলে আসে সুবর্ণা। বাইরে তারের জাল-বসানো একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। রামেশ্বরদের সঙ্গে সেটায় উঠতে উঠতে একবার পেছন ফিরে তাকায় রাজীব। বলে, চললাম মিসেস সিংহ। জীবনে আর হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হবে না।
একটু পর শীতের কুয়াশা এবং অন্ধকারে ভ্যানটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তার পরও আচ্ছন্নের মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্ণা। রাজীবের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে–ফাঁসি, না আমৃত্যু কারাদণ্ড? যদি কোনও দিন সে মুক্তি পায় আবার কি হাতে অস্ত্র তুলে নেবে? যার মধ্যে এই সর্বংসহ ভারতবর্ষের মতো এত করুণা, মায়া আর সহানুভূতি রয়েছে সে কি এ দেশ থেকে ছিন্ন হওয়ার কথা আবার নতুন করে ভাববে?
শীতের ঠান্ডা হাওয়া মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। কিন্তু কিছুই যেন টের পাচ্ছিল না সুবর্ণা।