হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে উঠল সুবর্ণা। রাজীবের ব্যাপারে তার স্নায়ুমণ্ডলী ক’দিন ধরে প্রচণ্ড একটা চাপের মধ্যে রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে সেগুলো ছিঁড়ে পড়বে। সুবর্ণা যেন ক্রমশ অথৈ জলে ডুবে যাচ্ছে। উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্বাচ্ছন্দ্য–সব মিলিয়ে এমন একটা অবস্থা যে সে আর পেরে উঠছে না। প্রাণপণে হাতের মুঠি শক্ত করে তার ভেতর রাজীবকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। মুঠিটা ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে।
রাজীব সম্পর্কে তাপসীরা যাতে বাড়তি কৌতূহল প্রকাশ করে না বসে বা মনে কোনওরকম সংশয় না রাখে সে জন্য ওদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল সুবর্ণা।
তাপসী রাজীবকে বলল, আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনি না থাকলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে যেতাম।
রাজীব বলল, কী আর এমন করেছি। এর জন্যে আবার কৃতজ্ঞতা কেন?
নমিতা বলল, সুবর্ণাদি, আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।
সুবর্ণা জানতে চাইল, কী?
রাত বেশি হয়নি, আপনারা জেগে ছিলেন, তাই রাজীবদা পারুল দে’কে সামলাতে পেরেছে। কিন্তু মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে যদি আবার ঝামেলা করে?
এমন একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখেনি সুবর্ণা। তাকে চিন্তিত দেখায়। বলে, ও যে ধরনের মহিলা–করতে পারে।
তখন কী হবে?
রাজীব এই সময় বলে ওঠে, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি রাত্তিরে এখানে থাকতে পারি। কড়া না হলে ওর খ্যাপামি বন্ধ করা যাবে না।
নমিতা এবং তাপসীর দুশ্চিন্তা অনেকখানি কেটে যায়। একসঙ্গে তারা বলে ওঠে, তা হলে তো আমরা বেঁচে যাই। আপনি থাকলে পারুল দে আর গোলমাল করতে সাহস পাবে না। আপনার ধমক ধামক শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে।
রাজীব বলল, আমি হল-ঘরে সোব। হরেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, একটা তালা পাওয়া যাবে?
যাবে। হরেন দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘর থেকে তালা চাবি নিয়ে এল। অবাক হয়ে রাজীবকে লক্ষ করছিল সুবর্ণা। বলল,তালা দিয়ে কী হবে? রাজীব বলল, আমি সারা রাত অ্যালার্ট থাকতে চেষ্টা করব। যদি ঘুমিয়ে পড়ি আর সেই ফাঁকে মহিলাটি পালানোর চেষ্টা করে তাই বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখতে চাই। চলুন, ওপর থেকে আমার বিছানা নিয়ে আসি।
সিঁড়ি ভেঙে পাশাপাশি দোতলায় উঠতে উঠতে সুবর্ণা বলল, আপনার এত বড় একটা রিস্ক নেওয়া উচিত হয়নি।
কীসের রিস্ক?
পারুল যখন ওপরে উঠে আসছিল তখন দৌড়ে গেলেন কেন?
আমি না গেলে ওকে কি ঠেকানো যেত?
কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যেত। এখন অনেকেই আপনাকে দেখে ফেলল। মানে–
রাজীব বলল, আমার সিকিউরিটির কথা নিশ্চয়ই ভাবছেন? আস্তে মাথা নাড়ল সুবর্ণা। রাজীব বলল, লুনাটিক মেয়েগুলোর মানসিক যা অবস্থা তাতে আমার সম্বন্ধে মাথা ঘামাবে না। দুই সোশাল ওয়ার্কার নমিতা আর তাপসী বিশ্বাস করেছে আমি আপনাদের আত্মীয়। তাছাড়া দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকবে। আমার ধারণা কোনওরকম প্রবলেম হবে না। একটু থেমে বলল, আসলে–
কী?
সমস্ত দিন কত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন। তবু এতগুলো মহিলার দায়িত্ব নিয়েছেন। ভাবলাম, চুপচাপ তো বসেই থাকি। যে ক’দিন এখানে আছি, আপনাকে যদি একটু সাহায্য করতে পারি–
সবিস্ময়ে রাজীবের দিকে তাকায় সুবর্ণা। একজন ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবাদী যে বেতাদের নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর কাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে, ভাবা যায়নি।
গভীর, আন্তরিক গলায় সে বলল, মোস্ট ওয়েলকাম–
দু’জনে সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় চলে আসে।
.
১৭.
নিরপরাধ, মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলারা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আসার পর রাজীবের নির্দেশমতো একতলার বাইরের দিকের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে রাখা হচ্ছে। কেউ এসে ডাকাডাকি করলে বা কড়া নাড়লে নাম জিজ্ঞেস করে হরেন তালা খোলে। মনোরমাদি বা বন্দনাদি ছাড়া বাইরের অন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থাটা মহিলাদের জন্য তো বটেই, তার চেয়েও অনেক বেশি করে রাজীবের জন্য।
সুবর্ণা লক্ষ করেছে, প্রথম দুদিন শুধু রাতটাই একতলায় কাটিয়ে এসেছে। রাজীব। পরে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া দিনরাত ওখানেই থাকছে। ক্রমশ আশ্রিতা
মহিলাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। বুঝতে পারছিল দীর্ঘকাল অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আর অকারণে জেল খাটার ফলে অদ্ভুত মানসিক রোগ এদের সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এরা কেউ সারাক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। কেউ অবসাদগ্রস্ত, কেউ ধন্দ-ধরা বা অত্যন্ত বিমর্ষ, কেউ চাপা করুণ সুরে কেঁদে যায়। পারুলের মতো দু-একজন আছে যারা মাঝে মাঝেই খেপে ওঠে। এদের সঙ্গ দিয়ে, মজার মজার গল্প বলে, নতুন নতুন আশার কথা শুনিয়ে স্বাভাবিক করে তুলতে চেষ্টা করছে রাজীব।
মনোরমাদি আর বন্দনাদির সঙ্গে এর মধ্যে তার আলাপ হয়েছে। রাজীব সুবর্ণাদের আত্মীয়, এটুকু জেনেই তারা সন্তুষ্ট। সে রোগগ্রস্ত মেয়েদের জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম করছে, সে জন্য কৃতজ্ঞও। খবরের কাগজে যে সন্ত্রাসবাদীর ছবি বেরিয়েছে সেটার সঙ্গে গোয়েন্দাদের মতো তার চেহারা মিলিয়ে দেখার চিন্তাও করেন নি ওঁরা। আসলে নারী কল্যাণ ছাড়া মনোরমাদিদের অন্য কোনও দিকে নজর নেই।
সুবর্ণা রাজীবকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। যে নিষ্ঠুর, বিচ্ছিন্নতাবাদী একদিন জোর করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢুকে পড়েছিল তার সঙ্গে এখানকার হৃদয়বান, সেবাপরায়ণ রাজীবের কোনও মিল নেই। আগাগোড়া সে বদলে যাচ্ছে।