ইমপসিবল। বছর খানেক আগে বাবাকে লাস্ট দেখেছিলাম। দাদা আর দিদিকে কতদিন যে দেখি না!
সুবর্ণা কিছু বলল না।
রাজীব বলে, বুঝতেই পারছেন নানা হাইড-আউটে লুকিয়ে থাকতে হয়।
পুলিশ আর জওয়ানরা ব্লাড হাউন্ডের মতো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দাদা আর দিদি অনেক দূরে থাকে। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া মুশকিল কিন্তু বাড়ি গিয়ে বাবাকে যে দেখে আসব, সেটাও ভীষণ রিস্কি।
সুবর্ণা বলল, ওঁদের জন্যে কষ্ট হয় না?
রাজীব বিষণ্ণ হাসে, হা, হয়। আপনার কি ধারণা, আমার সব হিউম্যান ফিলিংস নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি ঢুকেছিলেন, আপনি কিন্তু বলেছিলেন মানবিক কোনও অনুভূতি আপনার নেই।
রাজীব চমকে ওঠে, খুব অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলে, হ্যাঁ, বলেছিলাম। তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে একটা শেলটারের দরকার ছিল। তাই
তার কথাগুলো যেন শুনতে পাচ্ছিল না সুবর্ণা। হঠাৎ বলে ওঠে, আপনি কখনও কোনও জওয়ান, পুলিশ বা অন্য কাউকে–মানে–’বলতে বলতে থেমে যায়।
তীক্ষ্ণ চোখে সুবর্ণাকে লক্ষ করতে করতে রাজীব বলে, মার্ডার করেছি কিনা? যদি হিউম্যান ফিলিংস থাকে, করলাম কী করে? এটাই জানতে চাইছেন তো?’
সুবর্ণা উত্তর দেয় না।
রাজীব বলে, আপনি যদি কোনও একটা বড় লক্ষ্যের জন্যে যুদ্ধ করেন আর হাতে যদি রাইফেল থাকে তখন কত কী-ই তো ঘটে যেতে পারে। তবে সেন্সলেস কিলিং আমি পছন্দ করি না।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, তেমন কিছু কি ঘটছে না? খবরের কাগজে দেখি মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে কত লোককে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। এসব লক্ষ্যে পৌঁছুতে কতটা সাহায্য করে?
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাজীব। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলে, এত বড় একটা ব্যাপার; দু-চারটে ভুল হতেই পারে।
সুবর্ণা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই একতলায় প্রচণ্ড হইচই শোনা গেল। পরক্ষণে সিঁড়িতে দুপদাপ আওয়াজ। কারা যেন ঝড়ের বেগে ওপরে উঠে আসছে। সেই সঙ্গে নমিতা আর তাপসীর চিৎকার ভেসে এল, সুবর্ণাদি-সুবর্ণাদি, ওকে ধরুন, ধরুন–
চমকে রাজীব এবং সুবর্ণা মুখ ফিরিয়ে তাকায়। এক সঙ্গে দু’টো করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে এসেছে সেই মহিলাটি যার নাম পারুল। তার মুখে শব্দহীন, খ্যাপাটে হাসি, চোখে ঘোর-লাগা, হিংস্র দৃষ্টি। পারুলকে ধরার জন্য তার পেছন পেছন দিশেহারার মতো উঠে আসছে নমিতারা।
সুবর্ণা এতটাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছিল যে কী করবে ভাবতে পারছিল না। রাজীব কিন্তু বসে থাকল না, নিজের অজান্তেই যেন লাফ দিয়ে উঠে সিঁড়ির দিকে ছুটল। পারুল দোতলায় আসার আগেই তাকে ধরে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল।
এদিকে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠছিল সুবর্ণা। সেও ঊর্ধ্বশ্বাসে একতলায় নেমে এসেছে। ততক্ষণে রাজীব জোর করে পারুলকে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। নমিতা আর তাপসী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য মহিলারা ধারে কাছে নেই। নিজেদের ঘরের দরজার আড়াল থেকে শঙ্কাতুর চোখে পারুলদের দেখছে। হরেনকেও হল-ঘরের একধারে দেখা গেল।
সুবর্ণা তাপসীদের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? এত চেঁচামেচি কীসের?’ পারুলকে দেখিয়ে বলল, এ হঠাৎ দোতলার দিকে যাচ্ছিল কেন?
তাপসী খুবই সাহসী মেয়ে। তবু চিন্তিতভাবে বলল, জানি না। ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছিল। একবার বাইরের দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, আমরা যেতে দিইনি। একে কী করে সামলাব, বুঝতে পারছি না। হরেনকে দেখিয়ে বলল, উনি আমাদের হেল্প করতে এসেছিলেন, আঁচড়ে কামড়ে রক্ত বার করে দিয়েছে।
হরেন নিঃশব্দে তার দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ধরল। সে দু’টো সত্যিই রক্তাক্ত। কনুই থেকে হাতের পাতা পর্যন্ত অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ল।
তাপসী থামেনি, কোনওরকমে তিনজনে ধরে তো নিয়ে এলাম। তারপর হঠাৎ দোতলার দিকে দৌড় দিল–’
এই সময় অন্য যে মেয়েরা ঘরের ভেতর ছিল তাদের মধ্যে দু-তিনজন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
চকিত হয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, ওরা কাঁদছে কেন?
নমিতা বলল, জানি না। তখন আপনি চলে গেলেন, তারপর মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছে। জানতে চাইলে কিছু বলে না।
সুবর্ণা বলল, এ তো ভারি সমস্যার ব্যাপার।
এদিকে পারুল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দরজার দিকে দৌড় লাগাল। তাপসীরা চেঁচিয়ে ওঠে, পালিয়ে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে–
কেউ কিছু করে ওঠার আগেই রাজীব বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে পারুলকে ধরে নিয়ে আসে। জোর করে বসিয়ে দিতে দিতে বলে, কেন সবাইকে এত হয়রান করছেন?
পারুলের পরনের শাড়িটা আলুথালু, চুল উসকো-খুসকো। চোখে মুখে অদ্ভুত পাগলাটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সে চিৎকার করতে থাকে, বেশ করছি–বেশ করছি–
প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে রাজীব, চুপ, একদম চুপ। ফের অসভ্যতা করলে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখব।
হঠাৎ ভীষণ কুঁকড়ে যায় পারুল, ভয়ার্ত গলায় বলে, না না, আমাকে বেঁধে না।
খাওয়া হয়েছে?
পারুল উত্তর দেয় না। তাপসী জানায়, ফেলে ছড়িয়ে সামান্য কিছু খেয়েছে।
রাজীব পারুলকে বলল, যান, শুয়ে পড়ুন গিয়ে—
বাধ্য মেয়ের মতো নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে চলে যায় পারুল।
হঠাৎ সুবর্ণার মনে হল, রাজীব সম্পর্কে তাপসীদের নিশ্চয়ই কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। তারা প্রতাপপুর রাজবংশ সম্পর্কে সব জানে। শুনেছে, এ বাড়িতে কেউ বিশেষ আসে না। সুবর্ণার দু-একজন কলিগ বা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর কর্মীরা এলে নিচে থেকে তার সঙ্গে দেখা করে চলে যায়। মনোরমা আর বন্দনা ছাড়া অন্য কারও ওপরে যাওয়ার হুকুম নেই। যেখানে এ জাতীয় অলিখিত, কঠোর নিয়ম চালু রয়েছে সেখানে অপরিচিত একটি নোক কবে এ বাড়িতে এল, সুবর্ণাদের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক–তাপসীদের মনে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কথায় কথায় ওরা বাইরের কাউকে যদি রাজীবের কথাটা বলে ফেলে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে। সুবর্ণার হঠাৎ মনে হল, তাপসীদের তো বটেই, কাল মনোরমাদি আর বন্দনাদি এলে ওঁদেরও জানিয়ে দেবে। কেননা রাজীব সম্পর্কে মনোরমাদিদের কাছে গোপনীয়তা শেষ পর্যন্ত রাখা যাবে না। পারুলের মতো অস্বাভাবিক, খ্যাপা মেয়েকে সামলে যে তাদের দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিয়েছে তার কথা না বলে পারা যাবে না।