সুবর্ণাদের হাতে বারোটি মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার দায়িত্ব তুলে দিয়ে মনোরমা আর বন্দনা চলে গেলেন।
তারপরও কিছুক্ষণ একতলায় কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল সুবর্ণা। তার চোখে পড়ল, রাজীব শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে বসে আছে। অর্থাৎ মনোরমা নিচে নামার পর সে অস্ত্রাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
রাতে দেবীকে পড়িয়ে, সংগ্রামনারায়ণ এবং শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে অন্য দিনের মতো আজও ডাইনিং টেবলে খেতে বসেছিল রাজীব আর সুবর্ণা।
খেতে খেতে রাজীব বলল, আপনার রেসপনসিবিলিটি অনেক বেড়ে গেল মিসেস সিংহ। বাড়ির এতগুলো ডিউটি রয়েছে, কলেজ আছে, তার ওপর এই মহিলারা এসেছে। কী করে যে সামলাবেন ভেবে পাচ্ছি না।’
সুবর্ণা একটু হেসে বলল, একটা মাস তো। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
আশ্রিতা মহিলাদের সম্বন্ধে আবার কী বলতে যাচ্ছিল রাজীব, তাকে থামিয়ে সুবর্ণা বলল, আমার কথা তো সবই বলেছি, নিজের চোখেও অনেকটাই দেখেছেন। আপনার সম্পর্কে এখনও প্রায় কিছুই জানা হয়নি আমার।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রাজীব। তারপর যেন মনস্থির করে বলল, খুব কৌতূহল হচ্ছে?
সুবর্ণা বলল, সেটা স্বাভাবিক কিনা আপনিই বলুন। এক সঙ্গে কয়েক দিন আছি। নিজেই বলেছেন, আমাকে আর অবিশ্বাস করেন না। আপনার দ্বিধা থাকার কথা নয়।
ঠিক আছে। হয়তো বুঝতে পেরেছেন রাজীব আমার আসল নাম নয়। সেটা আর নর্থ-ইস্টের কোথায় আমাদের বাড়ি–এই দু’টো ছাড়া আর সবই বলছি।
অর্থবান বলতে যা বোঝায় রাজীবরা আদৌ তা নয়। মোটামুটি উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। তার বাবা একটা স্টেট গভর্নমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন, কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছেন। মা ছিলেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেড মিস্ট্রেস। তিনি বেঁচে নেই, প্যাংক্ৰিয়াসে ক্যানসার হয়ে মারা গেছেন।
রাজীবরা দুই ভাই, এক বোন। সে সবার ছোট। দাদা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে দিল্লিতে থাকে। সে ওখানকার একটা বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে বেশ উঁচু পোস্টে আছে। দিদি থাকে বাঙ্গালোরে। জামাইবাবু ব্যাঙ্ক অফিসার। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে। দিদিও একটা মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে চাকরি করে।
রাজীবদের বাড়ির প্রায় সবারই হায়ার এডুকেশন কলকাতায়। বাবা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইংরেজিতে এম. এ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দাদা যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ত। মা এবং দিদি ছিলেন লেডি ব্রাবোর্নের ছাত্রী। পরে কলকাতা থেকেই এম. এ পাস করেছে। মা হিস্ট্রিতে, দিদি বাবার মতোই ইংরেজিতে।
মা-বাবা দাদা-দিদির মতো রাজীবও পড়ত কলকাতায়–প্রেসিডেন্সি এবং সায়েন্স কলেজে। ওখান থেকে ফিরে গিয়ে কয়েক বছর একটা কলেজে পড়িয়েছে। সে। আগে থেকেই নর্থ-ইস্টের প্রতি বৈষম্য এবং ঔদাসীন্য ওই অঞ্চলে একটা অগ্নিগর্ভ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। অসংখ্য যুবক তখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সর্বত্র বাতাসে বারুদের গন্ধ। সমস্ত এলাকা নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে চলছে। এই সময় রাজীবের মনে হয়েছিল তারও কিছু একটা করা দরকার। কলেজ ছেড়ে সে একদিন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল।
প্রায় গোটা নর্থ-ইস্ট জুড়ে পুলিশ তো বটেই, আর্মি প্যারা মিলিটারি আর বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। হত্যা, মৃত্যু, অজস্র, রক্তপাত, ধরপাকড় এবং প্রবল উত্তেজনা–সব মিলিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত প্রতিদিন উত্তাল, প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনামে।
তিন চার বার আরও কয়েকজন মিলিটান্টের সঙ্গে ধরা পড়েছিল রাজীব। প্রতিবারই তারা পুলিশ বা আর্মির হাত থেকে পালিয়ে যায়। তবে খুব সহজে নয়, মুখোমুখি মারাত্মক লড়াইয়ের পর। দু’পক্ষই বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে। কনফ্রনটেসনে মারা গেছে অনেকে। একবার হাতে, একবার পায়ে, আরেক বার কাঁধে বুলেট লেগেছিল রাজীবের। তিনবারই দু-একমাস করে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। এছাড়া পুলিশ বা জওয়ানদের গুলি তার মাথা, বুক বা কানের পাশ দিয়ে কতবার যে বেরিয়ে গেছে, তার হিসেব নেই। যে কোনও মুহূর্তে তার মৃত্যু হতে পারত।
দিন কুড়ি আগে রাজীব এবং তার কয়েক জন সঙ্গী পাহাড় আর জঙ্গল-ঘেরা যে জায়গাটায় থাকত, আর্মি সেখানে একটা বড় রকমের অপারেশন চালায়। ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জওয়ানদের একটা জিপ তাকে দেখতে পেয়ে পিছু নেয়। রাজীব ঘন জঙ্গলে ঢুকে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ুতে থাকে। তিনটে জওয়ান জিপ থেকে নেমে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে চালাতে তার পিছু নেয় কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওরা আর তাকে খুঁজে পায় নি।
জঙ্গল আর পাহাড় ডিঙিয়ে পথ হারিয়ে ক’দিন আগে রাজীব প্রতাপপুর সিটিতে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু সে এখানে আসার আগেই খুব সম্ভব স্থানীয় থানাকে তার ছবি পাঠিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সেদিন প্রতাপপুর পুলিশের তাড়া খেয়ে সে প্যালেসে জোর করে ঢুকে পড়েছিল।
একটানা সব বলে জোরে শ্বাস টানল রাজীব। একটু হেসে বলল, এই হল আমার লাইফ হিস্ট্রি।
একটা চমকপ্রদ দমবন্ধ-করা কাহিনী যেন শুনছিল সুবর্ণা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সে। একসময় অবরুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে, আপনার মা তো নেই। বাবা, দাদা বা দিদির সঙ্গে দেখা হয়?