হাতের ঘড়ি দেখে মনোরমা বললেন, এখন পৌনে পাঁচটা বাজে। ছ’টার ভেতর ওরা চলে আসবে।
কথা বলছিল ঠিকই, তবে সুবর্ণার চোখ ছিল মহিলাদের দিকে। সে লক্ষ করল, পারুল ছাড়া বাকি সবাই খাচ্ছে। পারুল পরটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে মেঝেতে ফেলছে, পরক্ষণে তুলে থালায় রাখছে। কখনও বা চায়ের কাপে জল ঢেলে দিচ্ছে। তার মুখে পাগলাটে, শব্দহীন হাসি।
সুবর্ণা পারুলকে কী বলতে যাচ্ছিল, মনোরমা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ও যা করছে, করতে দাও। বাধা দিও না, কিছু বোলোও না। জেল থেকে বলে দিয়েছে যখন খিদে পাবে, ঠিক খেয়ে নেবে। ওর কোনও ব্যাপারে বাধা দিলে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে।
এমন একটা মহিলাকে বাড়িতে রাখা প্রচণ্ড ঝুঁকির ব্যাপার। কখন, কী কারণে হঠাৎ খেপে উঠবে, কে জানে। ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ই পেয়ে গেল সুবর্ণা।
মনোরমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেবো না, ওকে তোমার দেখতে হবে না। তাপসী আর নমিতাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাব; ওরা ঠিক সামলে নেবে।
সুবর্ণা মনে মনে আরাম বোধ করল। মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা
মনোরমা এবার বললেন, ওরা খেতে থাক। চল, তোমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।
রাজীবকে আগেই জানানো হয়েছিল চারটে নাগাদ মেয়েদের নিয়ে মনোরমা এ বাড়িতে আসবেন এবং দোতলায় গিয়ে সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে কথা বলবেন। রাজীব বলেছিল, মনোরমা দোতলায় ওঠার আগে তাকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয়। সুবর্ণা বলল, আপনি একটু বসুন। বাবা দুপুরে ঘুমোন তো। দেখে আসি জেগেছেন। কিনা। মনোরমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওপরে উঠে গেল সে।
রাজীব শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এলোমেলো পায়চারি করছিল। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তাঁর খাটে ঘুমোচ্ছিলেন। আর সংগ্রামনারায়ণ অন্য দিনের মতো তার বেডরুমের জোড়া জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলেন।
সুবর্ণা নিঃশব্দে, পা টিপে টিপে রাজীবের কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ওরা এসে গেছে।
রাজীব বলল, হ্যাঁ, অনেকের গলা শুনতে পাচ্ছি।
মনোরমাদি এখন দোতলায় আসবেন।
ঠিক আছে, আসুন না’
চিন্তিতভাবে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, আপনি—মানে–
রাজীব একটু হেসে বলল, সেটা ভেবে রেখেছি। আপনাদের যে অস্ত্রশালা আছে সেখানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে থাকব।
সেই ভাল।
আপনার মনোরমাদি কতক্ষণ থাকবেন?
কতক্ষণ আর, ম্যাক্সিমাম কুড়ি পঁচিশ মিনিট।
ঠিক আছে, ওঁকে নিয়ে আসুন।
যেভাবে এসেছিল তেমনি চুপিসারে নিচে নেমে গেল সুবর্ণা। মিনিট তিন-চারেক বাদে মনোরমাকে সঙ্গে করে ফের যখন ওপরে উঠল শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে রাজীবকে দেখা গেল না। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল, ডান পাশে রাজবংশের প্রাচীন অস্ত্রশালার দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
সুবর্ণা হল-ঘর পেরিয়ে সংগ্রামনারায়ণের ঘরের কাছে এসে ডাকল, বাবা–
শীতের সূর্য দূরের গাছপালার আড়ালে অনেকখানি নেমে গেছে। শুধু মাথার দিকের সামান্য একটা রক্তিম ফালি চোখে পড়ছে।
সন্ধের আগে আগে এই সময়টায় অঘ্রাণের মিহি কুয়াশা বিষাদের মতো নেমে আসছিল প্রতাপপুর সিটির ওপর।
সুবর্ণার কণ্ঠস্বর কানে যেতে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন সংগ্রামনারায়ণ। তার পাশে মনোরমাকে দেখে খুশি হলেন। কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। প্রতাপপুর সিটির এই একটি মাত্র মানুষ, বয়সে ছোট হলেও, তাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করেন তিনি। মনোরমাকে দেখলে তার দুচোখ স্নিগ্ধ, নরম হাসিতে ভরে যায়।
মনোরমাকে বসতে বলে সংগ্রামনারায়ণ খাটে বসলেন। সুবর্ণাকে বললেন, ওকে চা মিষ্টি টিষ্টি দিয়েছ বৌমা?’
মনোরমা বললেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না মেসোমশাই। আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আপনি কেমন আছেন বলুন।
সংগ্রামনারায়ণ হাসলেন, দু-তিনটে হার্ট-অ্যাটাকের পর যেমন থাকা উচিত তার চেয়ে অনেক ভাল আছি। সুবর্ণাকে দেখিয়ে বললেন, বৌমা সেবাযত্ন করে আমার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে।
একসময় প্রচণ্ড ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সুবর্ণাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। এখন প্রশংসা করে তার কিঞ্চিৎ ক্ষতিপূরণ করতে চাইছেন কি সংগ্রামনারায়ণ? বিয়ের পর চোদ্দ বছর কেটে গেছে। এই প্রথম ওঁর মুখে এ ধরনের কথা শুনল সুবর্ণা।
মনোরমা সস্নেহে বললেন, হ্যাঁ। ওর মতো মেয়ে হয় না। একটু চুপ করে থেকে ফের গম্ভীর গলায় শুরু করলেন, মেসোমশাই, আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কীসের কৃতজ্ঞতা?
আপনি নন-ক্রিমিনাল মেয়েগুলোকে আশ্রয় না দিলে ওদের নিয়ে খুব মুশকিলে পড়ে যেতাম।
আমাদের একতলাটা ফাঁকা পড়ে আছে। ক’টা নিরাশ্রয় মেয়ে না হয় থাকলই। সংগ্রামনারায়ণ বলতে লাগলেন, আমার লজ্জাটা কোথায় জানো? মেয়েরা এখানে থাকছে আর তোমরা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছ। আমাদের প্যালেসে এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি।
মনোরমা বিব্রত বোধ করলেন, এ নিয়ে মন খারাপ করবেন না মেসোমশাই। আমরা মেয়েদের জন্যে নানা জায়গা থেকে সাহায্য পাই। নিজেদের পয়সা তো খরচ করতে হয় না।
সংগ্রামনারায়ণ বিষণ্ণ একটু হাসলেন; কিছু বললেন না। মেয়েদের আশ্রয় দেবেন, অথচ খাওয়াতে পারবেন না–তার রাজকীয় মর্যাদায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে।
আরও কিছুক্ষণ পর মনোরমা বিদায় নিলেন। সুবর্ণা তার সঙ্গে নিচে নেমে এল। নমিতা আর তাপসী ছ’টার মধ্যে চলে এসেছিল। মনোরমা তাদের সঙ্গে মহিলাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এখন থেকে তোমরা এদের দেখাশোনা করবে। সুবর্ণা তো আছেই। আশা করি কোনও প্রবলেম হবে না। রোজ না পারলেও দু-একদিন পরপর আমি বা বন্দনা এসে দেখে যাব।