সংগ্রামনারায়ণও সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এখানেই দিতে বল।
সুবর্ণা চলে যায়। মায়া নয়, নিজেই সংগ্রামনারায়ণদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছের পাত্রগুলো যখন সে সাজিয়ে দিচ্ছে সেই সময় সংগ্রামনারায়ণ বলছিলেন, কাগজে তোমাদের মিলিটান্ট অ্যাক্টিভিটির কথা অনেক পড়েছি। এজাক্টলি তোমরা কী চাও?
রাজীব বলল, আমরা এক্সপ্লয়টেড হচ্ছি; এটা বন্ধ করতে চাই। আমাদের এথনিক আইডেনটিটি ধ্বংস হতে বসেছে; সেটা কিছুতেই হতে দেবো না।
তোমরা কি ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হতে চাও?
এই প্রশ্নটা সেদিন বিমলেশও করেছিল। খাদ্যবস্তুগুলো সাজাতে সাজাতে চকিতে একবার মুখ তুলে রাজীবের দিকে তাকায় সুবর্ণা।
রাজীব বলল, মিস্টার সিংহ, আপনারা নিজেদের আইডেনটিটি যে কোনও কারণেই তোক হারিয়েছেন। আমরা হারাতে চাই না। এর জন্যে যতদূর যেতে হয় যাব। তারপর দেখা যাক–
১৬. সুবর্ণার কলেজে যাওয়া হল না
১৬.
পরদিনও সুবর্ণার কলেজে যাওয়া হল না। তবে রাজীবকে জানিয়ে হরেনের সঙ্গে দেবীকে স্কুলে পাঠিয়ে দিল। হরেনই তাকে ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসবে।
বিকেলের দিকে তিনটে ট্যাক্সিতে করে বারজন মানসিক ভারসাম্যহীন নিরাশ্রয় মহিলা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে এল। তাদের নিয়ে এসেছেন মনোরমা। অধিকারী এবং বন্দনা সাহা। দু’জনে প্রায় সমবয়সী। মনোরমার মতো বন্দনাও ঝাড়া হাত-পা মানুষ, কোনওরকম পিছুটান নেই। প্রতাপপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে ভাল। চাকরি করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর ডেপুটি সেক্রেটারি। নারী কল্যাণ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না।
প্রথমে খবর দেওয়া হয়েছিল এগারো জন আসবে। পরে জেল থেকে জানানো হয় সংখ্যাটা এগারো নয়, বারো। অর্থাৎ একজন বেশি। যা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে বাড়তি একটি মহিলার জন্য অসুবিধা হবে না।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নিচে নেমে অপেক্ষা করছিল সুবর্ণা। মনোরমাদি মহিলাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ছবি মালাকার, সন্ধ্যা ভট্টাচার্য, মালতী রায়, নলিনী সেন, পদ্মা কর্মকার, জবা মণ্ডল, গোপালীবালা সাহা, তারা সর্দার, লতিকা মৈত্র, বিন্দুবাসিনী দাস, পার্বতী বর্মন এবং পারুল দে। এদের বয়স তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে।
তিনজন বাদে অন্যদের মোটামুটি সুস্থই মনে হল সুবর্ণার। তবে কেমন যেন জড়সড়, উদ্বিগ্ন, ভীত। অদৃশ্য খোলের ভেতর নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে তারা। বিনা অপরাধে দীর্ঘকাল জেলে কাটিয়ে মুক্তি পাওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় হয়তো ভুলছে। হয়তো ওরা শুনেছে মাসখানেক ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ আশ্রয় পাবে। তারপর কোথায় যাবে জানে না। যাদের সামনে শুধুই অন্ধকার, তাদের চোখে মুখে এইরকম নৈরাশ্য, উৎকণ্ঠা আর আড়ষ্টতা বুঝি সর্বক্ষণই লেগে থাকে। বাকি তিনজনকে একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে পারুল দে নামের মহিলাটিকে। বছর চল্লিশেক বয়স হলেও বেশ সুশ্রী এবং স্বাস্থ্যবতী। চোখের দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত উগ্রতা। সে মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখছিল।
একতলার চারটে বেডরুমে খাট পেতে রাখা হয়েছিল। তিনটে ঘরে চারজন করে মহিলা থাকবে। নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর যে দু-তিনজন কর্মী এই মহিলাদের দেখাশোনা করবে বাকি ঘরটা তাদের জন্য। রান্নার দু’জন লোক থাকবে বাড়ির পেছন দিকে যে পড়ো সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো রয়েছে তার একটা ঘরে। নীচের তলাটা সাফ করার সময় ওটাও সামান্য মেরামত করে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।
এক মাসের অতিথিদের জন্য আগেই পরটা আর আলু ভাজা করে রেখেছিল রান্নার লোকেরা। তাদের চা করতে বলে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখাল সুবর্ণা।
মনোরমা এবং বন্দনা, দু’জনেই বললেন, চমৎকার ব্যবস্থা হয়েছে। ওঁরাই ঠিক করে দিলেন আশ্রিতারা কে কোন ঘরে থাকবে।
মহিলারা কাপড়ের ব্যাগে বা টিনের সুটকেসে জামাকাপড় এবং টুকিটাকি কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিল। ব্যাগ-ট্যাগগুলো তারা গুছিয়ে রাখল।
প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম। সুবর্ণা প্রতিটি ঘরে গিয়ে মহিলাদের সেগুলো দেখিয়ে বলল, আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে নিন। চা-খাবার আসছে।
কিছুক্ষণ পর হল-ঘরে রান্নার লোকেরা মেয়েদের চা আর খাবার দিয়ে গেল। ওদের সঙ্গ দেবার জন্য মনোরমা, বন্দনা আর সুবর্ণা এক কাপ কার চা নিল।
কাপে চুমুক দিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের সব সময় দেখাশোনার জন্য কারা আসবে মনোরমাদি?
মনোরমা বললেন, নমিতা আর তাপসী।
নমিতা সান্যাল আর তাপসী বসু নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সক্রিয় কর্মী। দু’জনেই চাকরি করে। সুবর্ণা বলল, কিন্তু নমিতার স্কুল আর তাপসীর অফিস আছে। ওরা। কি টানা একমাস এখানে পড়ে থাকতে পারবে?
না না, অতদিন ওদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ওরা দশদিনের ছুটি নিয়েছে।
তারপর?
মনোরমা জানালেন নমিতা আর তাপসীর পর দশদিনের জন্য আসবে পরমা এবং মমতা, তারপর সুরভি আর অঞ্জলি। তিনি যাদের নাম করলেন তারাও চাকরি-বাকরি করলেও নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সঙ্গে আন্তরিকভাবে যুক্ত। প্রতাপপুর সিটির এরকম বহু মেয়ের মধ্যেই সমাজসেবার বীজ বুনে দিয়েছেন মনোরমা।
সুবর্ণা বলল, কই, নমিতা আর তাপসী তো এখনও এল না?