সংগ্রামনারায়ণের একটা হাত ধরে খুব সহৃদয় ভঙ্গিতে রাজীব বলল, আপনারা আমাকে শেলটার দিয়েছেন। আমি আপনাদের কোনওরকম ক্ষতি করব না। দয়া করে চুপচাপ থাকুন। আমার কথা কাউকে বলবেন না। একটু থেমে বলল, জানি, আপনাদের ভীষণ বিপদে ফেলেছি। কিন্তু খুব বেশিদিন না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাব।
সংগ্রামনারায়ণ তাকিয়ে রইলেন শুধু; কিছু বললেন না।
সুবর্ণা অবাক হয়ে রাজীবকে দেখছিল। খানিক আগের সেই হিংস্রতা আর নেই। তার ভেতর থেকে একজন হৃদয়বান, সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ যেন বেরিয়ে এসেছে।
সংগ্রামনারায়ণের বালিশের পাশে সবসময় একটা ভাঁজ-করা ধবধবে তোয়ালে থাকে। সেটা তুলে নিয়ে রাজীব সযত্নে তার ভেজা চুল, মুখ মুছিয়ে দিয়ে পাশে বসে বলল, বুকে কি পেইন হচ্ছে?
যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে পিস্তল তাক করেছিল সে যে কয়েক মিনিটের ভেতর এতটা বদলে যেতে পারে, এমন অভাবনীয় দৃশ্য নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সংগ্রামনারায়ণ। বিহ্বলভাবে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন–যন্ত্রণা হচ্ছে না।
রাজীব জিজ্ঞেস করল, অন্য কোনওরকম অস্বস্তি?
নিচু গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, না।
রাজীব সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি আশঙ্কা করছিলেন তেমন কোনও সিম্পটম দেখা যাচ্ছে না। আপাতত ডাক্তার ডাকার দরকার নেই।
সুবর্ণা চুপ করে রইল।
রাজীব বলল, আমি ওঁর কাছে বসছি। আপনার দাদাশ্বশুরের খাওয়া শেষ হয়নি; তাকে খাইয়ে আসুন।
সুবর্ণা দ্বিধান্বিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাজীবের হাতে সংগ্রামনারায়ণকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারে না।
রাজীব তার মনোভাব আন্দাজ করে নিয়ে বলে, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান। আমার কোম্পানি ওঁর খারাপ লাগবে না।
সুবর্ণা খানিকটা নিরুপায় হয়েই যেন দু’জনের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যায়। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে ফের ভাতের প্লেট তুলে নিয়ে তাকে দ্রুত খাইয়ে, মুখটুখ ধুইয়ে রাজীবদের কাছে ফিরে যায়। আসলে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা বোধ করছিল সে। যদিও সংগ্রামনারায়ণ অজ্ঞান হওয়ার পর শুশ্রূষা করে তাঁকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলেছে রাজীব, তবু একা ঘরে একজন ভয়াবহ সশস্ত্র উগ্রপন্থীর সঙ্গ তার কতটা ভাল লাগছে, ভাবতে পারছিল না সুবর্ণা। সংগ্রামনারায়ণের ঘরে পা দিয়ে সে দারুণ অবাক হয়ে যায়।
রাজীব একটা চেয়ার খাটের কাছে টেনে নিয়ে বসে বসে কথা বলছিল। সংগ্রামনারায়ণ এখন আর শুয়ে নেই; খাটের মাঝখানে রাজীবের দিকে মুখ করে বসে আছেন। তার চোখে মুখে আতঙ্ক বা বিহ্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। খুব স্বাভাবিক আর সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে।
রাজীব বলছিল, মিসেস সিংহ, মানে আপনার পুত্রবধুর কাছে শুনেছি ইন্ডিপেনডেন্সের পর নেটিভ স্টেটগুলো যখন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে ঢুকে গেল আপনারা তা মেনে নিতে পারেননি।
সংগ্রামনারায়ণের দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, তোমার হৃৎপিণ্ড যদি কেউ উপড়ে নেয়, তুমি সেটা মেনে নেবে? জওহরলাল প্যাটেলরা জোর করে আমাদের স্টেট ছিনিয়ে নিল। ছিলাম স্বাধীন রাজা, একটা রাজ্যের সর্বময় অধীশ্বর। এখন আমাদের স্টেটাসটা কী? রিকশাওলা, ঠেলাওলা, রাস্তার হকার, কেরানি–এদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা কোথায়? রাজবংশের মর্যাদা, স্বাধীনতা, গৌরব, সর্বস্ব গেছে। রাস্তার ধুলোয় আমাদের মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষোভ নয় রাজীব, যতদিন বেঁচে থাকব আমার রাগ যাবে না।
একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না—
কী?
ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা, হায়দ্রাবাদের নিজাম তো অ্যাকসেসন মেনে নিতে চাননি। তারা আপত্তি করেছিলেন। আপনারাও করতে পারতেন।
ত্রিবাঙ্কুর, হায়দ্রাবাদ অত বড় স্টেট। তারাই কিছু করতে পারল না। প্রতাপপুরের মতো ছোট রাজ্য কী আর করতে পারে।
একটু চিন্তা করে রাজীব বলল, ইন্ডিয়ায় তিনশ’র মতো নেটিভ স্টেট ছিল। সবাই জয়েন্টলি রুখে দাঁড়ালে অ্যাকসেসন কি হতে পারত?
হঠাৎ ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন সংগ্রামনারায়ণ। নির্জীব সুরে বললেন, সকলে ইউনাইটেড আর হতে পারল কোথায়? বেশির ভাগ স্টেটই তো ইন্ডিয়ার পেটের ভেতর ঢুকে যাবার জন্যে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। জওহরলালদের গুড বুকে থাকার জন্যে সে যে কী র্যাটরেস বলে বোঝাতে পারব না। দু-একটা স্টেটের যাও আপত্তি ছিল, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, আর অন্য পলিটিক্যাল পার্টির ওয়ার্কাররা এমন তুলকালাম কাণ্ড বাধাল যে কিছুই করা গেল না। সর্বগ্রাসী এক হতাশা যেন সংগ্রামনারায়ণের ওপর ভর করে।
সুবর্ণা ঘরে ঢুকে চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ রাজীবের চোখ এসে পড়ে তার ওপর। বলে, কতক্ষণ এসেছেন?
সুবর্ণা বলে, এই মিনিট পাঁচেক।
ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?
আপনাদের কথা শুনছিলাম। রাজীব সামান্য হেসে বলল, তখন টেনান নিয়ে এ ঘর থেকে গেলেন। জিজ্ঞেস করে দেখুন আমার কোম্পানি আপনার শ্বশুরমশাইয়ের খুব খারাপ লাগছে না।
সুবর্ণা উত্তর দিল না। রাজীব নামে এই সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা ম্যাজিক আছে, নইলে সংগ্রামনারায়ণের মতো সন্দিগ্ধ, সর্বক্ষণ ক্ষিপ্ত একটি মানুষকে কী করে বশ করল?
রাজীব বলল, মিসেস সিংহ, আপনাদের বাড়ির ডেইলি রুটিন আমার জানা হয়ে গেছে। আপনার শ্বশুরমশাইয়ের লাঞ্চের সময় হয়েছে। প্লিজ মায়াকে বলুন, ওঁর আর আমার ভাত যেন এখানে দিয়ে যায়। মিস্টার সিংহর সঙ্গে গল্প করতে খুব ভাল লাগছে।