পায়ের তলায় শ্বেত পাথরের মসৃণ মেঝে দুলে উঠল সুবর্ণার। মনে হল মাথার ভেতর আগুনের চাকার মতো কিছু একটা ঘুরে যাচ্ছে।
সংগ্রামনারায়ণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, একে চিনতে পারছ?
হোয়াইট ইংক লাগানোর পর রাজীবের এখনকার নিখুঁত কামানো মুখটা বেরিয়ে পড়েছে। নির্জীব স্বরে কিছু বলতে চেষ্টা করল সুবর্ণা, তার একটা শব্দও বোঝা গেল না।
সংগ্রামনারায়ণ আবার বললেন, এই তোমার আত্মীয়-বৌদির পিসতুতো ভাই? প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল, লোকটার সঙ্গে তোমাদের কোনওরকম সম্পর্ক নেই। জোর করে এখানে ঢুকে পড়েছে। একটু থেমে কী ভেবে বললেন, বৌমা, একটা সত্যি কথা বল তো, লোকটা তোমাকে ভয় দেখিয়ে আমাদের সবাইকে কি হোস্টেজ করে রেখেছে?
সংগ্রামনারায়ণ দাম্ভিক, রুক্ষ, রগচটা হলেও খুবই চতুর। তার ইন্দ্রিয়গুলো ভীষণ প্রখর। তাঁর চোখে ধুলো দিয়ে কিছু হওয়ার উপায় নেই। হোয়াইট ইংক লাগিয়ে রাজীবের আসল মুখটা যে তিনি বার করে ফেলবেন, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সুবর্ণা। নিজের অজান্তেই মাথাটা খুব আস্তে হেলিয়ে দেয় সে।
সাঙ্ঘাতিক হার্ট অ্যাটাকের কারণে তার যে উত্তেজিত হওয়া বারণ, স্নায়ুমণ্ডলীকে সব সময় যে শান্ত রাখা উচিত, সে সব আর মনে থাকে না সংগ্রামনারায়ণের। লাফ দিয়ে খাট থেকে নিচে নামতে নামতে গর্জে ওঠেন, রাসকেলের এত বড় সাহস, থ্রেটনিং দিয়ে প্যালেসে ঢুকে আছে। আমি ওকে লাথি মেরে–
ভয়ে শ্বাস যেন আটকে যায় সুবর্ণার। হাত বাড়িয়ে সংগ্রামনারায়ণের একটা হাত ধরে ফেলে সে, বাবা, যাবেন না, যাবেন না। ও যে কী ডেঞ্জারাস লোক আপনার ধারণা নেই।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে সংগ্রামনারায়ণ বলেন, অনেক ডেঞ্জারাস লোক আমার দেখা আছে–’ তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরের দিকে দৌড়ে যান।
আতঙ্কিত সুবর্ণার চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল। তবু তারই মধ্যে সংগ্রামনারায়ণের পেছন পেছন সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে।
ইউ স্কাউন্ড্রেল–শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে এসে গলার শির ছিঁড়ে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে ওঠেন সংগ্রামনারায়ণ, তোমার এত বড় স্পর্ধা যে–শরীরের সব রক্ত যেন তার মুখে উঠে এসেছে। চোখ দু’টো বুঝিবা ফেটে পড়বে। গালের কষ বেয়ে ফেনার মতো কিছু বেরিয়ে আসছে।
সংগ্রামনারায়ণ চেঁচাতে চেঁচাতে রাজীবের ওপর প্রায় আঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন; সুবর্ণা পেছন থেকে প্রাণপণ শক্তিতে দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভীত, দুর্বল গলায় বলে, বাবা শান্ত হোন, শান্ত হোন, আপনার ঘরে চলুন—
কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না সংগ্রামনারায়ণ। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন।
এদিকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে রাজীব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। দুই চোখের ভেতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছে ভীতিকর এক হিংস্রতা। একটা হাত মুঠো পাকানো। আরেকটা হাত ট্রাউজারের পকেটে। সে তীব্র, চাপা গলায় বলল, স্টপ মিস্টার সিংহ, স্টপ–
হইচই শুনে কিচেনের দিক থেকে মায়া ছুটে এসেছিল। চোখের ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল সুবর্ণা।
হুমকি সত্ত্বেও সংগ্রামনারায়ণ কিন্তু থামেননি। তাঁর মাথায় যেন হিস্টিরিয়া ভর করেছে। কণ্ঠস্বর আরও উঁচুতে তুলে তিনি বলে যাচ্ছিলেন, খুনি হোক, ডাকু হোক-রাজবাড়িতে যে শেলটার নেয় তার ক্ষতি আমরা করি না। তোমাকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেবো না। তবে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না। নাউ গেট আউট–’
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই পিস্তল বের করে সংগ্রামনারায়ণের বুকের দিকে তাক করল রাজীব। খুব ঠান্ডা গলায় বলল, আই রিপিট–স্টপ।
প্রতিক্রিয়া হল ভয়ানক। সংগ্রামনারায়ণ যতটা ক্রুদ্ধ আর উত্তেজিত হয়েছিলেন; এখন ঠিক ততটাই আতঙ্কিত। পিস্তলের দিকে তাকিয়ে তার চোখের তারা দু’টো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। মুহূর্তে সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল। গোঙানির মতো অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে আওয়াজ করে তিনি মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, সুবর্ণা পড়তে দিল না। মূৰ্ছিত সংগ্রামনারায়ণকে কোনওরকমে ধরে রাখল। রাজীবকে বলল, এ আপনি কী করলেন?
পিস্তলটা পকেটে পুরে রাজীব বলল, ওটা না দেখালে ভদ্রলোক যেভাবে চেঁচাচ্ছিলেন, একতলা থেকে লোকজন ছুটে আসত। আমাকে কত রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে হত, ভেবে দেখুন। চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে সাহায্য করছি।
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ ধন্দ-লাগা, বিহ্বল মানুষের মতো তাকিয়ে ছিলেন। তার অসাড় মস্তিষ্কে দৃশ্যটা হয়তো সামান্য ধাক্কা দিয়ে থাকবে। কিছু বলতে চাইলেন, গলা দিয়ে স্বর বেরুল না। ঠোঁট দু’টো অল্প নড়ল শুধু। রাজীব আর সুবর্ণা ধরাধরি করে সংগ্রামনারায়ণকে তার ঘরে এনে শুইয়ে দিল।
তিন-চার মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড বিপর্যয় ঘটে গেছে যেন। দিশেহারার মতো সুবর্ণা বলল, এখন আমি কী করি বলুন তো? বাবার বোধ হয় আরেকটা অ্যাটাক হয়ে গেল। ডাক্তারকে এখনই খবর দিতে হবে। কাল থেকে অতগুলো মহিলা এসে থাকবে। আমি যে কী করব!
রাজীব বলল, হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মায়াকে বলুন জল দিয়ে যেতে। যদি দেখি জ্ঞান ফিরছে না তখন ডাক্তার ডাকবেন। । সুবর্ণা দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে জলের জগ নিয়ে এল। তার হাত থেকে। সেটা নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে লাগল রাজীব। মিনিট পাঁচেক পর চোখ মেলে ঘোর-লাগা মানুষের মতো তাকালেন সংগ্রামনারায়ণ। এই প্রকাণ্ড বেডরুমের কোনও কিছুই যেন তার কাছে পরিষ্কার নয়। সব ঝাপসা, ঘোলাটে। ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে এল। চারপাশের দৃশ্যগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। খাটের এক ধারে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুবর্ণা। আরেক ধারে সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে দেখতে পেলেন। সে অনেকখানি ঝুঁকে তাকে লক্ষ করছে। আবার সেই আতঙ্কটা তার চোখে মুখে ফিরে এল। ভয়ার্ত স্বরে বললেন, আমি-–আমি–’