বিমলেশ সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, এই জন্যেই কি হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছেন?
রাজীব এক পলক তাকাল শুধু; উত্তর দিল না।
বিমলেশ এবার বলল, আপনাদের যা মুভমেন্ট, গভর্নমেন্ট সেটা কোনওভাবেই মেনে নেবে না। তারা কড়া—
রাজীব হাত তুলে উত্তেজিত সুরে বলল, মিলিটারি অ্যাকসনের কথা বলছেন তো? প্রতি মুহূর্তে সেটা টের পাচ্ছি। কত যুবক মারা গেছে ভাবতে পারবেন না।
হ্যাঁ, প্রচুর প্রাণহানি, রক্তক্ষয়–’
দিস ইজ ইনএভিটেবল বিমলেশবাবু।
বিমলেশ বলল, একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করছে–’
রাজীব জিজ্ঞেস করল, কী?
শুধু নর্থ-ইস্টেই না, ইন্ডিয়ার আরও কয়েক জায়গায় সেসেসানিস্ট মুভমেন্ট চলছে। ধরুন ছোট ছোট কয়েকটা অংশ আলাদা হয়ে বেরিয়ে গেল। ইনডিপেনডেন্ট স্টেট হিসেবে সেগুলো টিকে থাকা কি সম্ভব?
রাজীব বলল, আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের কাছে এই ধরনের ওয়র্থলেস প্রশ্ন আশা করিনি। ইওরোপ, সাউথ আমেরিকা, কি কাছাকাছি মিডল ইস্টের ছোট স্টেটগুলোর কথা ভুলে গেছেন? এই সেদিন সোভিয়েট রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে কতকগুলো নেশন তৈরি হল? তারা টিকে নেই?
আবার দুই জার্মানি তো এক হয়ে গেছে। তার পেছনে অন্য কারণ ছিল। ওদের ধর্ম এক, ভাষা এক। সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের পর জোর করে জার্মানিকে দু’ভাগ করা হয়েছিল। প্রবল জাতীয় আবেগ ওদের রিইউনাইট করেছে।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর বিমলেশ বলল, বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিটান্সি তা হলে চলতেই থাকবে? রাজীব এই প্রথম একটু হাসল। বলল, আপনি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন দেখছিঃ বিরাট বিরাট একান্নবর্তী পরিবারও সুখের জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ হয়ে যায়। এটাকে সেভাবে ভাবতে অসুবিধা কোথায়?
বিমলেশ বলল, আপনার কাছে এবার একটা বিষয়ে জানতে চাইব।
বলুন কী জানতে চান—
শুনলে আপনি নিশ্চয়ই রেগে যাবেন। তবু ঝুঁকি নিয়েই প্রশ্নটা করছি।
চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল রাজীবের। বলল, আগে শুনি। রাগের কথা তো পরে–
বিমলেশ বলে, কাগজে প্রায়ই দেখি, আমাদের দেশে যেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হচ্ছে তার সবগুলোই বিদেশি রাষ্ট্রের উসকানিতে। ইন্ডিয়াকে দুর্বল করার এ এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এমনকি ডেসট্রাক্টিভ অ্যাক্টিভিটির জন্য মিলিটান্টদের বাইরে নিয়ে ট্রেনিংও দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র স্মাগল করে ঢোকানো হচ্ছে দেশের ভেতর। এ বিষয়ে আপনি কি কিছু বলবেন?
মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে রাজীবের। সে বলে, আপনি বোধহয় ঘুরিয়ে জানতে চাইছেন, আমরা বিদেশি রাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে এখানে কাজ করছি কি না? খুব সংক্ষেপে বলছি–না। এর বেশি আর কিছু এখন আর জানতে চাইবেন না। ভবিষ্যতে যদি কখনও দেখা হয়, সে সম্ভাবনা নেই বললেই হয়–আপনার সঙ্গে ডিটেলে আলোচনা করা যাবে। শুধু একটাই অনুরোধ–
বিমলেশ দু চোখে অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকাল।
রাজীব থামেনি, ভাসা ভাসা কিছু ইনফরমেশনের ভিত্তিতে নয়, আমাদের সমস্যাগুলো গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন। বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, আচ্ছা নমস্কার।
বিমলেশ আর সুবর্ণাও উঠে পড়ে। রাজীব বুঝিয়ে দিয়েছে সে আর কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।
.
১৫.
সেই যে বিমলেশ এসেছিল তার দু’দিন পর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল।
কাল জেল থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েরা মুক্তি পেয়ে বিকেলের দিকে সোজা এখানে চলে আসবে। রাজীব শেষ পর্যন্ত আপত্তি করেনি, সংগ্রামনারায়ণের অনুমতিও পাওয়া গেছে।
একতলার ঘরগুলো খুলিয়ে ধুলো ময়লা সাফ করার জন্য সকাল থেকেই লোক লাগানো হয়েছে। সুবর্ণা আজ আর কলেজে যাবে না, দেবীকেও স্কুলে পাঠাবে না। মোট বারোজন মহিলা আসছে। সুষ্ঠুভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে যে বাড়তি লেপ-তোষক বালিশ-টালিশ আছে তাতে কুলোবে না। ডেকরেটরদের কাছ থেকে কয়েক সেট বিছানা ভাড়া করা দরকার। অবশ্য খাওয়ানোর দায়িত্ব তাদের নয়। নারী বিকাশ কেন্দ্র থেকে সে বন্দোবস্ত করা হবে। কাল ভোরে মনোরমাদি রান্নার লোকের সঙ্গে চাল ডাল মাছ আনাজ তেল নুন, যা যা প্রয়োজন সব পাঠিয়ে দেবেন। নিজে তখন আসবেন না, আসবেন সেই বিকেলবেলায় মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে।
সকাল থেকে নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে একতলায় এসে খোঁজ খবর নিয়ে গেছে সুবর্ণা। যদিও হরেনকে লাগিয়ে রেখেছে, তবু নিজের চোখে না দেখলে যেন স্বস্তি হচ্ছিল না।
অঘটনটা ঘটল দুপুরবেলায়। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে তখন তার ঘরে খাওয়াচ্ছিল সুবর্ণা। একধারে সোফায় বসে বই পড়ছিল রাজীব। হঠাৎ সংগ্রামনারায়ণের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বৌমা–বৌমা, তাড়াতাড়ি একবার এখানে এসো। তো–
রাজীব এবং সুবর্ণা দু’জনেই চমকে ওঠে। সুবর্ণা হাতের প্লেটটা খাটের পাশের সাইড টেবলে নামিয়ে রেখে একরকম দৌড়েই সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে আসে।
সংগ্রামনারায়ণ খাটের মাঝখানে বসে ছিলেন। তাঁর হাতে একটা খবরের কাগজ। সেটা সুবর্ণার দিকে বাড়িয়ে একটা ছবিতে আঙুল রেখে বললেন, লুক হিয়ার–এ কে?
কাগজটা কয়েকদিন আগের দৈনিক দিনকাল’-এর সেই কপি, যার প্রথম পাতায় রাজীবের ছবিসুদ্ধ বিরাট রিপোর্ট বেরিয়েছিল। রাজীবের ছবিতে এখন দাড়ি নেই, হোয়াইট ইংক দিয়ে সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে।