তাকে শেষ করতে দিল না রাজীব। তার আগেই অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠল, ছেলেবেলা থেকে এসব শুনতে শুনতে কান পচে গেছে বিমলেশবাবু। বিবিধের মাঝে মহান মিলন, ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি, নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান সত্ত্বেও ঐক্যের অটুট বন্ধন–এই বস্তাপচা বুলিগুলো দশ বছরের বাচ্চাও জানে। আমি আপনার কাছে অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলাম।
বিমলেশ কী বলবে ভেবে পেল না; তাকে খানিকটা দিশেহারার মতো দেখাচ্ছিল।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রাজীব। পেছনে দুই হাত রেখে অস্থিরভাবে হল-ঘরে মিনিট খানেক পায়চারি করার পর ফিরে এসে আবার বসল। তারপর নিজের মতো করে বলতে লাগল, বিমলেশবাবু, ইংরেজরা আসার আগে কী ছিল ইন্ডিয়া? বিশাল ভৌগোলিক বাউন্ডারির ভেতরে ছোট বড় কাউন্টলেস নাম্বার অফ স্টেটস। একটার সঙ্গে অন্যটার সম্পর্ক নেই। যুদ্ধ, শত্রুতা লেগেই থাকত। ব্রিটিশ রুল চালু হওয়ায় ইন্ডিয়া যে একটা নেশন সেটা বোঝা গেল–নানা ল্যাংগুয়েজ, নানা রিলিজিওন, নানা ফুড হ্যাবিট, নানা সোশাল প্যাটার্ন সত্ত্বেও। তখন হিন্দু মুসলিম শিখ, সবার সামনে একটা লক্ষ্য ছিল–স্বাধীনতা। মুক্তির জন্য সারা দেশ সেই বোধ হয় প্রথম ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের পর ইংরেজরা যখন যাই যাই করছে তখন কী দেখলাম আমরা? কমিউনালিজম দাঁত নখ বার করে ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে। ফর্টি
সেভেনে টু নেশন থিয়োরির ধাক্কায় ইন্ডিয়া দু ভাগ হয়ে গেল। এক নেশন ভেঙে দু’টো নেশল হল। জওহরলালরা অবশ্য জানালেন, আমাদের ভাগে যেটুকু পড়েছে সেটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সেটা নিশ্চয়ই খুব বড় ব্যাপার।
বিমলেশ বলল, এসব ভারতবর্ষের সবাই জানে। আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।
একটু ধৈর্য ধরুন। আমি যা বলতে চাই, সেখানে পৌঁছুবার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। স্বাধীনতার পর সেকুরালিজমের আদর্শ কতটুকু টিকে আছে? রিলিজিয়াস ফান্ডামেন্টালিজম কীভাবে বাড়ছে, নিশ্চয়ই আপনি জানেন। সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রাদেশিকতা, জাতপাতের সমস্যা। বম্বে প্রেসিডেন্সি দু’ভাগ হয়ে হল মহারাষ্ট্র আর গুজরাট, মাদ্রাজ ভেঙে হল অন্ধ্র আর। তামিলনাড়ু, নর্থ-ইস্ট এখন সাত টুকরো, যদিও তাদের বলা হয় সেভেন সিস্টার্স। তা হলে স্বাধীনতার পর আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, জাতপাতের সমস্যা–সব মিলিয়ে পিপলের মধ্যে ডিভিসন কিন্তু হয়েই চলেছে। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান বাঙালি বিহারী তামিল বা মারাঠি, ব্রাহ্মণ রাজপুত ক্ষত্রিয় বা যাদব–এসবের বাইরে কেউ আর কিছু ভাবতে চায় না। এর মধ্যে ভারতীয়ত্বটা কোথায় বলতে পারেন?
বিমলেশ আর সুবর্ণা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। বিমলেশ বলল, হ্যাঁ, এগুলো ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার। দেশের মানুষের মধ্যে এই বিভাজন নেশন হিসেবে আমাদের চরম ক্ষতি করছে।
রাজীব বলল, আরেকটা মারাত্মক দিক লক্ষ করছেন?
কী?
ইন্ডিয়ার কয়েকটা অঞ্চল হাইলি ডেভলাপড। সে সব জায়গায় বিপুল ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে; দেশের বেশির ভাগ ওয়েলথ ওখানে জমা হচ্ছে। বাকি জায়গাগুলো আন্ডার-ডেভলাপড। সেখানে কোনওরকম ইনভেস্টমেন্ট নেই। হলেও খুব সামান্য। বিশেষ করে ইস্টার্ন আর নর্থ-ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখুন, এ দু’টো অঞ্চল কীভাবে পিছিয়ে পড়ছে। আর্থিক সচ্ছলতা সব জায়গায় যদি সমানভাবে না আসে, ক্ষোভ জমা হতে হতে বিস্ফোরণের চেহারা নেয়। নিচ্ছেও। যারা হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে তাদের কিছু কিছু ঘুষ অবশ্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা হবে কেন?
বিমলেশ উত্তর দিল না।
রাজীব বলতে লাগল, এবার নিজের কথা বলা যাক। আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে স্বাধীনতার পর কতটুকু ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে? প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তাছাড়া সাঙ্ঘাতিক একটা সমস্যা হল, আমাদের এথনিক আইডেনটিটি অত্যন্ত বিপন্ন।
বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, কীরকম?
রাজীব বলল, আপনারা তো জানেনই নর্থ-ইস্টে কী বিপুল পরিমাণে ন্যাচারাল রিসোর্সের্স রয়েছে–টি, ফরেস্ট, পেট্রোলিয়াম। ইংরেজরা তো লুট করেছেই। তারপরও এক্সপ্লয়টেশন চলছে। ব্রিটিশ আমলে ইন্ডিয়ার নানা জায়গা থেকে হাজার হাজার লোক চাকরি বাকরি নিয়ে ওখানে সেটল করেছিল। পার্টিশনের পর এসেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এখন চলছে ইনফিলট্রেশন। রোজ কত ফ্যামিলি যে লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়ছে তার হিসেব নেই। এর রেজাল্ট কী হতে পারে ভাবতে পারেন?
কী?
রাজীব জানাল, আর কিছুদিন এরকম চললে তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। তাদের জাতি-পরিচয়, সংস্কৃতি, ভাষা, বাইরের মানুষের চাপে ধ্বংস হয়ে যাবে। সেটা তারা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারে না।
বিমলেশ বলল, এর সমাধান কি দিল্লির সঙ্গে আলোচনা করে হতে পারে না?
রাজীব বলল, আলোচনা, অ্যাকর্ড, কত কিছুই তো হল। খবরের কাগজে সেসব আপনারা পড়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে?
সমস্যাটা এত জটিল আর বিরাট এবং দীর্ঘকালের যে তার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হওয়া কি সম্ভব? ধৈর্য তো ধরতে হবে।
ধৈর্য ধরতে ধরতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর দেরি করলে আমরা সন্স অফ দা সয়েল, পুরোপুরি শেষ হয়ে যাব।