সুবর্ণা বলে, উনি অত্যন্ত রেসপেক্টেড টিচার। ওঁকে এভাবে চলে যেতে বলা যায় না।
কী একটু ভাবে লোকটা। তারপর বলে, ঠিক আছে, আপনি গিয়ে বলে আসুন। দরজা খুলবেন, কিন্তু আপনাদের টিউটরকে ভেতরে ঢুকতে দেবেন না।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুবর্ণাকে বলতে হয়, আচ্ছা দেবীকে নিয়ে সে পরের সিঁড়িটায় পা রাখতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বাধা পড়ল। লোকটা দেবীকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলে, নো নো, আপনি একাই যান। আপনার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
লোকটার এক হাতে পিস্তল, আরেক হাতে দেবীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। সুবর্ণা লক্ষ করল, দেবীর সমস্ত শরীর ভীষণ কাঁপছে। এবার সে সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। বিমূঢ়ের মতো বলে, কিন্তু
তার মনোভাব বুঝতে পারছিল লোকটা। বলল, আপনি যদি গোলমাল না করেন, কোনও সমস্যাই নেই। আপনার মেয়ে আমার কাছে নিরাপদে থাকবে। তবে ওর সেফটি টোটালি ডিপেন্ড করছে আপনার অ্যাক্টিভিটির ওপর। যান–
ল্যান্ডিংয়ের পাশেই একটা গোল পিলার। দেবীকে নিয়ে সেটার আড়ালে চলে যায় লোকটা। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। ওখান থেকে বাইরের দরজার দিকে নজর রাখা যায়। কিন্তু দরজার বাইরে থেকে তাকে খুব সহজে দেখা যাবে না।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুবর্ণার পা খুব কাঁপছিল। হঠাৎ কী মনে পড়তে লোকটা ডাকে, শুনুন–
সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়ায়। লোকটা বলে, আপনাদের টিউটরের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা বলবেন না। এমনভাবে বলবেন যাতে এখান থেকে আমি শুনতে পাই। আমার সম্বন্ধে ওঁকে কিছু জানাবেন না, এমনকি ইঙ্গিতেও না। এক মিনিটের ভেতর ভদ্রলোককে বিদায় করে ফিরে আসবেন। যান–
সুবর্ণা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে।
লোকটা বলে, মাস্টারমশাইকে বলবেন, আপাতত এক উইক তার আসার দরকার নেই।
সুবর্ণা বিঢ়ের মতো বলে, এ আপনি কী বলছেন! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি সিম্পল বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজে কথা বলছি। না বোঝার কোনও কারণ নেই ম্যাডাম। কিন্তু–
কী?
মাস্টারমশাইকে এক উইক আসতে বারণ করব কেন?
লোকটা বলে, কারণ একটা উইক আমাকে এখানে থাকতে হতে পারে। আমি চাই না এই সাতদিন বাইরের কেউ এসে আমাকে দেখতে পাক।
সুবর্ণা চমকে ওঠে, আপনি সাতদিন এ বাড়িতে থাকবেন।
দরকার হলে সাতদিন কেন, দু-এক মাসও থেকে যেতে পারি।
এই সময় কড়া নাড়ার আওয়াজ জোরাল হয়ে ওঠে। বোঝা যায় দেবীর টিউটর ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন। সুবর্ণা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা বলে, আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
হল-ঘরে নেমে দরজার দিকে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকায় সুবর্ণা। একটু আগে লোকটার বাঁ-হাতে পিস্তলটা ঝুলছিল। এখন সেটা উঠে এসে দেবীর কপালের ডান পাশের রগের ওপর ঠেকে আছে। দৃশ্যটা এমনই ভয়ঙ্কর যে দেখতে দেখতে সুবর্ণার মনে হয়, শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কোনওরকমে মুখটা ফিরিয়ে উতে টলতে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
.
০২.
লোকটার কথামতো দেবীর মাস্টারমশাইকে বিদায় করে দরজায় খিল তুলে ফের সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে চলে আসে সুবর্ণা! ম ট,শাই মানুষটি অত্যন্ত প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক। প্রতাপপুর সিটির সবাই তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। দুই জেনারেশন ধরে এই শহরের অসংখ্য ছেলেমেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তিনি নিজের হাতে তৈরি করে দিয়েছেন। তাদের কেউ এখন সধ্যা, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আই.এ.এস বা আই.পি.এস, কেউ বিদেশে ভারতীয় রাষ্ট্র। কেউ আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে, কেউ বা ইউনাইটেড নেশনসে। সারা পৃথিবী জুড়ে তার ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে রয়েছে। এমন একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের সঙ্গে সুবর্ণা যে ব্যবহার আজ করেছে তা খুবই অসম্মানজনক। সে তাঁকে দরজার এধারে পা রাখতে দেয়নি, ওপার থেকেই সামান্য দু-একটা কথা বলে চলে যেতে বলেছে। ব্যাপারটা এমনই গ্লানিকর যে ভেতরে ভেতরে লজ্জায় অনুশোচনায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। দেবীকে পড়াতে এসে তাকে এভাবে ফিরে যেতে হবে, এমন ঘটনা আগে আর কখনও ঘটেনি। শান্ত, সংযত, অন্তর্মুখী মানুষটি একটু অবাক হয়েছিলেন ঠিকই, তবে কোনও প্রশ্ন করেননি, নিঃশব্দে চলে গেছেন। কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে এমন একটা জঘন্য আচরণ সুবর্ণাকে করতে হয়েছে সেটা আজ জানানো সম্ভব হয়নি। সে ঠিক করে ফেলেছে, পরে সব জানিয়ে তার কাছে ক্ষ: চেয়ে নেবে। যতক্ষণ না ক্ষমাটা চাওয়া হচ্ছে, মানসিক অস্থিরতা, অস্বস্তি আর অপরাধবোধ কিছুতেই কাটবে না তার।
সুবর্ণার দিকে আগাগোড়া নজর রেখেছিল লোকটা! নির্বিঘ্নে এবং অক্ষরে অক্ষরে তার হুকুম পালিত হয়েছে দেখে সে মোটামুটি খুশি। দেবীর কপালের পাশ থেকে এবার পিস্তলের নলটা সরিয়ে আস্তে আস্তে পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।
সাহস বলতে কিছুই প্রায় অবশিষ্ট ছিল না সুবর্ণার মধ্যে। যে তলানিটুকু পড়ে আছে প্রাণপণে তা জড়ো করে সে বলে, সাতদিন মাস্টারমশাই আসবেন না। মাস দেড়েক বাদে দেবীর অ্যানুয়াল একজামিনেশন। ওর পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।
লোকটা উত্তর দিল না।
সুবর্ণা আবার বলে, আপনি তখন বললেন, এক উইক থাকবেন। দরকার হলে দু-একমাসও থেকে যেতে পারেন।
লোকটা আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
উদ্বিগ্ন মুখে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, যতদিন আপনি থাকছেন, মাস্টারমশাই কি আসতে পারবেন না?