পরদিন কলেজ ছুটির পর একটা ট্যাক্সি করে বিমলেশকে বাড়ি নিয়ে এল সুবর্ণা। অবশ্য দেবীকেও তার স্কুল থেকে তুলে এনেছে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাড়ির একটা কাজে সকালেই হরেনকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। রাত ন’টার আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই। রাজীব সম্পর্কে আগেই তাকে সব জানিয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। তবু বিমলেশের সঙ্গে রাজীবের দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সে জানুক, সুবর্ণা তা একেবারেই চায় না। একতলায় বিমলেশকে বসিয়ে বলল, প্লিজ, তুমি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। দু-একটা কাজ সেরে আমি ওকে নিয়ে আসছি।
দেবীকে সঙ্গে করে দোতলায় চলে গেল সুবর্ণা। ওপরে বাইরের কাউকে নিয়ে যাবার আগে সংগ্রামনারায়ণকে জানাতে হয়। বিমলেশের কথা বললে হাজার রকমের কৈফিয়ত দিতে হত। আসলে একজন প্রাক্তন উগ্রপন্থীর সঙ্গে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদীর সাক্ষাৎকারটা সংগ্রামনারায়ণের চোখের সামনে ঘটুক, এটা কোনও ক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়।
আজ কলেজে বেরুবার সময় বিমলেশের কথাটা মাথায় রেখে মায়াকে বেশি করে খাবার আর বড় ফ্লাস্ক বোঝাই করে কফি করে রাখতে বলেছিল সুবর্ণা । ওপরে এসে দ্রুত শাড়িটাড়ি পালটে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাইয়ে, সংগ্রামনারায়ণ আর দেবীর খাওয়ার ব্যবস্থা করে, ট্রেতে তিনজনের মতো খাবার, জলের গেলাস আর কফির ফ্লাস্কটা সাজিয়ে নিয়ে রাজীবকে বলল, বিমলেশ এসেছে।
রাজীব জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
একতলায়।
সঙ্গে আর কেউ নেই তো?
না।
চলুন—
রাজীব সারাক্ষণ তার পিস্তলটা কাছেই রাখে। সেটা পকেটে পুরে সুবর্ণার সঙ্গে নিচে নেমে এল।
ওদের দেখে বিমলেশ উঠে দাঁড়িয়েছিল। টেবলে ট্রে নামিয়ে রেখে সুবর্ণা দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিল।
নমস্কারের পর্ব চুকলে রাজীবরা বসে পড়ে। বিমলেশ বলে, আপনার কথা সুবর্ণার কাছে শোনার পর থেকে আলাপ করার খুব ইচ্ছা হয়েছিল। আপনি যে আপত্তি করেননি, সে জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
রাজীব উত্তর দিল না; একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। সুবর্ণা বলা সত্ত্বেও বিমলেশ কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেটাই যেন মেপে নিতে চাইছে সে।
সুবর্ণা এই সময় বলে ওঠে, খেতে খেতে গল্প করা যাক। দু’জনকে খাবারের প্লেট দিয়ে নিজেও একটা তুলে নিল সে।
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ খাওয়ার পর রাজীব বলল, বিমলেশবাবু, মিসেস সিংহের ওপর আমার খানিকটা আস্থা হয়েছে বলে আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছি। আপনাকে উনি বিশ্বাস করেন। আশা করি আপনি তার মর্যাদা রাখবেন।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছিল বিমলেশ। হেসে হেসে বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নেই।
রাজীব বলল, এবার বলুন আমার মতো মারাত্মক একটা লোকের সঙ্গে আলাপ করার শখ হল কেন?
আপনাকে সুবর্ণা বলেনি?
সেভাবে কিছু বলেন নি। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।
বিমলেশ বলল, এক সময়, ধরুন চব্বিশ পঁচিশ বছর আগে, উগ্রপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমার এবং আমার মতো হাজার হাজার যুবকের বিশ্বাস ছিল, আমর্ড রেভোলিউশন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থা বদলানো যাবে না।
রাজীব বলল, আপনাদের আন্দোলনের কথা আমি জানি। সেই সময় সমস্ত দেশ এর ধাক্কায় তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ। স্বাধীন ভারতে এটা ছিল নতুন ধরনের মুভমেন্ট।
কিন্তু—
বলুন–
আন্দোলনটা থেমে গেল কেন?
থামে নি তো। তীব্রতা হয়তো কমে গেছে কিন্তু সারা ভারতবর্ষের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন এখনও ওটা চলছে। অবশ্য নানা কারণে আমার মতো অনেকেই আর অ্যাক্টিভলি জড়িত নেই।
রাজীব উত্তর দিল না।
বিমলেশ বলতে লাগল, সোশাল সিস্টেম একদিন দু’দিনে বদলানো যায় না। আন্দোলনটা হল অন্তহীন একটা প্রসেস। আমাদের প্রসঙ্গ থাক, আপনার কথা। শুনতে চাই।
রাজীব জিজ্ঞেস করল, আমার কী কথা?
দেখুন, আমরা ভারতবর্ষের মধ্যে থেকেই এখানকার সমাজ ব্যবস্থা পালটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাগজে যেটুকু পড়েছি কিংবা অন্যান্য সোর্স থেকে যা জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে, আপনারা ইন্ডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান।
আপনার কথার নিশ্চয়ই উত্তর দেবো। তার আগে ইন্ডিয়া ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিন।
বিমলেশ বলল, কোটি কোটি মানুষের বিশাল এক দেশ। আ সভারেন, ইনডিপেনডেন্ট কান্ট্রি।
রাজীব বলল, এ তো ক্লাস ফোরের পাঠ্য বইতে পাওয়া যাবে। আপনার মতো অত্যন্ত শিক্ষিত, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে এক সময় যুক্ত মানুষের কাছ থেকে এত সরল উত্তর আশা করিনি।
রাজীব ঠিক কী জানতে চাইছে, বুঝতে না পেরে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে বিমলেশ।
একটু ভেবে রাজীব এবার বলল, স্টুডেন্ট লাইফ থেকে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় পার্মানেন্টলি ভর করে আছে। বলতে পারেন, ওটা আমাকে হন্ট করে বেড়াচ্ছে। দেশ নিয়ে যাঁরা ভাবেন–পলিটিশিয়ান, এডুকেশনিস্ট, সোশাল সায়েন্টিস্ট, এমন অনেককে জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু কারও কাছ থেকেই পরিষ্কার উত্তর পাইনি। সবাই গোঁজামিল দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। বাট আই অ্যাম নট রিয়ালি স্যাটিসফায়েড। প্রশ্নটা আপনাকে কি করতে পারি?
বিমলেশ বলল, বেশ তো, করুন না। উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয়ই দেবো।
রাজীব বলল, ইন্ডিয়াননেস, মানে ভারতীয়ত্ব বস্তুটা আসলে কী?
বিমলেশ লক্ষ করল, গলার স্বরে চাপা বিদ্রূপ মিশিয়ে বস্তু’ শব্দটা উচ্চারণ করেছে রাজীব। বলার ভঙ্গিটা খট করে কানে লাগল তার। ধীরে ধীরে বলল, হাজার হাজার বছর ধরে নানা ধরনের মানুষের তৈরি কালচার, জীবনদর্শন, আমাদের ইতিহাস, আমাদের সিভিলাইজেশন–সব মিলিয়ে–