সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব টেবলের ওপর সামান্য ঝুঁকে বলে, এ বাড়িতে আসার পর আপনার শ্বশুর, দাদাশ্বশুরকে দেখছি। কিন্তু আপনার স্বামী–মানে তিনি কি বাইরে থাকেন?
সুবর্ণা আস্তে মাথা নাড়ে, না। আমি ডিভোর্সি। সে অন্য একজনকে বিয়ে করে যতদূর জানি দিল্লিতে ছিল। এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। এ বাড়ির সঙ্গে বহু বছর তার কোনও সম্পর্ক নেই।
রাজীব অবাক হয়ে যায়; কিছু বলে না।
তার মনোভাবটা মুহূর্তে বুঝে নেয় সুবর্ণা। এই সন্ত্রাসবাদী লোকটা তার ভেতরকার কোনও একটা স্পর্শকাতর জায়গায় যেন হাত দিয়ে ফেলেছে। সে বলে, ডিভোর্সের পর কেন এখানে পড়ে আছি, তাই জানতে চান তো?
রাজীব আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
শুধু এটুকু বললে বুঝবেন না। পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটাই তাহলে শুনুন।
রাজীব উদ্গ্রীব তাকিয়ে থাকে।
সুবর্ণার ওপর হঠাৎ কী যেন ভর করে বসে। ঘোরের মধ্যে সে বলতে শুরু করে।
কখনও কখনও মানুষ নিজের অতীতকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চায়। রাজীব উপলক্ষ মাত্র। অচেনা এই লোকটাকে সামনে বসিয়ে সুবর্ণা যেন নিজেকেই নিজের কথা শোনাতে থাকে। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। তবে মনে মনে নয়, স্পষ্ট উচ্চারণে।
সমস্ত শোনার পর মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছিল রাজীবের। সে বলল, সংগ্রামনারায়ণ আর বিক্রম, দুজনেই দেখছি জঘন্য টাইপের স্কাউড্রেল। একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। কমোনার হওয়ার জন্যে। আরেক জনের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু পাননি। তবু আপনি এখানে পড়ে আছেন?
মৃদু হাসির একটা রেখা সুবর্ণার মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। সে বলে, একজন বোধবুদ্ধিহীন বুড়ো মানুষ, আরেক জন অসহায় হার্ট পেশেন্টকে ফেলে কি যাওয়া যায়?
মানবিকতা?
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
অদ্ভুত হেসে রাজীব বলল, আপনি দেখছি পৃথিবীর মতো সর্বংসহা। ঘৃণা, বিশ্বাসভঙ্গ–কোনও কিছুই আপনাকে বিচলিত করে না।
সুবর্ণা এবারও কিছু বলল না; নিঃশব্দে খেতে লাগল।
রাজীব ফের বলল, মিসেস সিংহ, আপনি আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। সকাল থেকে শ্বশুর, দাদাশ্বশুরের সেবা, মেয়েকে পড়ানো, কলেজ, সোশাল ওয়ার্ক, এত সব কী করে যে সামলান ভেবে পাই না। ইউ আর আ লেডি এক্সট্রা-অর্ডিনারি। আপনার মতো মহিলা আমি আগে কখনও দেখিনি।
ভয়ঙ্কর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী যে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’কে সর্বক্ষণ চরম আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে, নিজের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কিছু যে ভাবে না, তার মুখ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্য শোনার পরও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব থামেনি, আপনার সম্বন্ধে একটা কথা যে কতবার ভেবেছি তার ঠিক। নেই।
সুবর্ণার চোখেমুখে ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে। তার সম্পর্কে রাজীব যে কিছু ভাবতে পারে–সেটা খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। সে জিজ্ঞেস করে, কী ভেবেছেন?
আপনি ইচ্ছা করলে দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশে খবর দিতে পারতেন। তারা বাড়ি কর্ডন করলে আপনার শ্বশুর আর দাদাশ্বশুর নিশ্চয়ই বেঁচে থাকত না। পুলিশের গুলিতে আমিও হয়তো ঝাঁঝরা হয়ে যেতাম কিংবা ব্লাস্ট করে এই প্যালেস উড়িয়ে নিজেও মরতাম। পুলিশকে ইনফরমেশন দেবার জন্য মাঝখান থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা তো পেতেনই, যে ব্লাডি সোয়াইন শ্বশুর আপনাকে এত অপমান করেছে, যে হ্যাঁজব্যান্ড চরম বিট্রে করেছে তাদের বংশকে ভাল রকম শিক্ষা দিতে পারতেন। এত বড় সুযোগ পেয়েও কাজে লাগালেন না।
সুবর্ণা চমকে ওঠে, এ আপনি কী বলছেন! আপনাকে তো আগেই জানিয়েছিলাম, এই বংশের অজস্র অপরাধ আর ত্রুটির মধ্যে একটা আউটস্ট্যান্ডিং কোয়ালিটি রয়েছে। এরা যাকে আশ্রয় দেয় তার ক্ষতির কথা চিন্তা করে না। এ বাড়ি থেকে আমি কিছুই পাইনি, কোনওরকম প্রত্যাশাও নেই। তবে ওদের এই গুণটাকে শ্রদ্ধা করি। মনে করি–আশ্রয় প্রার্থীর, সে যেমনই হোক, সর্বনাশের কথা ভাবা অন্যায়। একটু থেমে বলল, আর সংগ্রামনারায়ণদের শিক্ষা দেবার কথা বললেন তো? রিভেঞ্জ বা ভেনডেটা, এসব গল্পেই পড়েছি, ফিল্মেও দেখেছি। নিজের জীবনে? ইমপসিবল। প্রতিহিংসা শব্দটাকে আমি ঘৃণা করি। আই হেট ইট।
নিষ্ঠুর ভাবাবেগহীন এক বিচ্ছিন্নতাবাদীর চোখে মুখে শ্রদ্ধা কিংবা মুগ্ধতার মতো কিছু একটা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। রাজীব বলে, সেই জন্যেই তো বললাম ইউ আর আ লেডি এক্সট্রা-অর্ডিনারি।’
এমন অনর্গল প্রশংসার উত্তরে স্বাভাবিকভাবে ধন্যবাদ জানানোই নিয়ম। সুবর্ণা কিন্তু কিছু বলল না।
খানিক নৈঃশব্দের পর রাজীব ফের শুরু করে। যেন আপন মনে বলে যায়, কতদিন এ বাড়িতে থাকতে পারব জানি না। রাতে আপনারা ঘুমিয়ে পড়লে রোজ ছাদে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। চোখে পড়ে চারদিকে প্লেন ড্রেসের পুলিশ ফাঁদ পেতে রেখেছে। রাজবাড়ি বলে, কিংবা আপনার কথা বিশ্বাস করে পুলিশ এখানে সেভাবে হানা দেয়নি। তবে ওরা মনে করে এদিকেই কোথাও আমি লুকিয়ে আছি।
রাজীব ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে না পেরে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় সুবর্ণা।
রাজীব থামেনি, খুব বেশিদিন আমি আপনাদের এখানে থাকব না। এ বাড়ি থেকে বেরুলে পুলিশ বা মিলিটারি, যাদের সঙ্গেই হোক, এনকাউন্টারে আমার মৃত্যু অনিবার্য। যতদিন বাঁচি, আপনার কথা আমার মনে থাকবে মিসেস সিংহ। শেষ দিকে তার কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে আসে।
১৪. পরদিন কলেজ ছুটির পর
১৪.