তা তো আসবেনই।
তারা কিংবা নন-ক্রিমিনালরা, কেউ কিন্তু দোতলায় উঠতে পারবে না।
দেখুন, মনোরমাদি বন্দনাদি এমনি আরও যাঁরা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সঙ্গে জড়িত তারা এ বাড়িতে এলে ওপরে উঠে শ্বশুরমশাই আর দাদাশ্বশুরকে দেখে যান। আমার শ্বশুরমশাই বাইরের কেউ দোতলায় উঠলে ভীষণ রেগে যান। ওয়ান্স হি ওয়াজ আ কিং, এখনও নিজেকে রাজাই মনে করেন। কমোনারদের সম্পর্কে তার ভয়ঙ্কর ঘৃণা। কিন্তু আমাদের নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অ্যাক্টিভিস্টদের, বিশেষ করে মনোরমাদিকে খুব পছন্দ করেন। লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্যে সারাটা জীবন যেভাবে ডেডিকেট করেছেন, সম্ভবত সেই কারণে। ওঁরা এলে কীভাবে আটকাবো?
স্থির দৃষ্টিতে সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করে মনোরমাদের এ বাড়িতে আসার ভেতর কোনওরকম সূক্ষ্ম চাল রয়েছে কিনা। সুবর্ণা সেটা আঁচ করে নিয়ে দ্রুত বলে ওঠে, আমাদের অ্যাক্টিভিস্টদের সম্পর্কে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, টরচার্ড ডিসকার্ডেড মেয়েদের বেঁচে থাকা আর ওদের বাঁচিয়ে রাখা, এর বাইরে ওঁরা আর কিছু ভাবতে পারেন না। আপনি মনোরমাদিদের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
রাজীব বলল, ঠিক আছে। শুধু ওঁরা দোতলায় ওঠার আগে আমাকে জানিয়ে দেবেন। আমি অন্য কারও চোখে পড়তে চাই না।
আচ্ছা।
এখন পর্যন্ত যেটুকু দেখেছি তাতে আপনাকে অবিশ্বাস করার কারণ ঘটেনি। যে ক’দিন আছি, আশা করি, তেমন কিছু ঘটবে না।
রাজীব যে ক্রমশ তার প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছে, এতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল সুবর্ণা। এই সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একটা বিপজ্জনক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বক্ষণ ভয় আর আতঙ্ক। রাজীব যদি মনে করে, সুবর্ণারা কোনওরকম ক্ষতি করবে না, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ সে নিরাপদে থাকতে পারবে, তাহলে তার উগ্রতা কমে আসবে। সুবর্ণার প্রচণ্ড টেনসনও অনেকটাই হালকা হয়ে যাবে। হঠাৎ বিমলেশের মুখটা মনে পড়ল। এই হচ্ছে সুযোগ। তার সম্পর্কে রাজীবের সংশয় কেটে যেতে শুরু করেছে। এখনই বিমলেশের কথাটা বলা যেতে পারে।
খানিক নৈঃশব্দের পর সুবর্ণা বলল, আপনি যদি ভরসা দেন, একটা অনুরোধ করব।
রাজীব বলল, করুন।
আমার এক কলিগ একসময় উগ্রপন্থী আন্দোলনের একজন লিডার ছিল। দারুণ অনেস্ট আর আইডিয়ালিস্ট। এখন অবশ্য কোনওরকম মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত নেই। সে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। যদি–
হোয়াট? সুবর্ণার কথা শেষ হতে না হতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। চাপা, ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, আমি যে এ বাড়িতে আছি, সে জানলে কী করে? আপনি বলেছেন?
বসুন। খুব শান্ত গলায় সুবর্ণা বলল, আমার সব কথা শুনলে বুঝতে পারবেন আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।
তার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে রাজীবের রাগ এবং উত্তেজনা অনেকটাই কমে আসে। সুবর্ণার চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে ফের বসে পড়ে সে।
সুবর্ণা বলে, বিমলেশ অত্যন্ত ইনটেলিজেন্ট। আপনি এ বাড়িতে আসার পরদিন খবরের কাগজে যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল সেটা পড়ে ও সিওর হয়ে যায়, আপনি আমাদের বাড়িতেই আছেন। আমাকে তার ধারণার কথা বলে। আমি প্রথমে স্বীকার করিনি। পরে এমনভাবে বোঝায় যে আমাদের বাড়ি ছাড়া আপনার পক্ষে অন্য কোথাও থাকা সম্ভব নয়। আমাকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হয়। না থেমে এক নিঃশ্বাসে সে বলে যায়, বিমলেশ আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী। আমাকে যদি বিশ্বাস করতে পারেন, ওকেও পারবেন।
রাজীব উত্তর দিল না।
একটানা বলতে বলতে হাঁফিয়ে পড়েছিল সুবর্ণা। জোরে শ্বাস টেনে ফের শুরু করে, একটা কথা ভেবে দেখুন, চারদিন আগে বিমলেশ আপনার খবরটা পেয়ে গেছে। ওর লোভ থাকলে পুলিশকে জানিয়ে দিতে পারত। তারা প্যালেস ঘিরে ফেললে আমরা হয়তো শেষ হয়ে যেতাম কিন্তু আপনিও রক্ষা পেতেন না। বিমলেশ ইনফরমেশনটা দেবার জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়ে যেত।
এতক্ষণে রাজীবের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। মাংসের ঝোলে রুটির একটা টুকরো ডুবিয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে সে জিজ্ঞেস করে, আপনার বন্ধু আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান কেন?
খুব সম্ভব কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে চায়।
কী বিষয়?
সেটা ও-ই বলবে।
রাজীব বলল, মনে হচ্ছে বিমলেশবাবু আমার সঙ্গে আলাপ করেন সেটা আপনিও চান। ঠিক আছে, ওঁকে নিয়ে আসবেন।
এত সহজে রাজীব রাজি হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি সুবর্ণা। বলল, কবে আনব?’
কাল কলেজ ছুটির পর আনতে পারেন।
চুপচাপ কিছুক্ষণ দু’জনে খেয়ে যায়। চারদিন রুদ্ধশ্বাসে কাটানোর পর এই প্রথম অনেকটা সহজভাবে বাইরের হাওয়া ফুসফুসে টানতে পারছে সুবর্ণা। ইদানীং সারারাত প্রায় জেগে জেগেই কেটে যায়। আজ খুব সম্ভব ভাল করে ঘুমোতে পারবে সে।
রাজীব ডাকল, মিসেস সিংহ–
বলুন।
আপনি আমাকে শেলটার দিয়েছেন, আপনার হসপিটালিটির তুলনা হয় না। একই বাড়িতে আমরা আছি, অথচ আপনার সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানি না।
আমিও তো একই কথা বলতে পারি। আপনার সম্পর্কে খবরের কাগজের রিপোর্টটা ছাড়া আর কিছুই আমারও জানা নেই।
রিপোের্টটা তো হাজার হাজার পাঠক পড়েছে। কিন্তু আমি যে কতটা ভীতিকর লোক, আমার মধ্যে কী ধরনের নিষ্ঠুরতা রয়েছে সে অভিজ্ঞতা শুধু আপনারই হয়েছে। সেটা কিন্তু কম জানা নয়। তবু যদি আরও জানতে চান, পরে কখনও বলা যাবে। আজ কিন্তু আপনার কথা শুনব।