রাজীব ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে বই পড়ছিল। ধীরে ধীরে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয়ই আপনার মনোরমাদির সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।
হ্যাঁ।
কী জন্যে উনি আপনাকে ডেকেছিলেন?
মনোরমার সঙ্গে তার যা কথা হয়েছে, সব জানিয়ে ছিল সুবর্ণা। তারপর বলল, কী যে করব, বুঝে উঠতে পারছি না। বলে রাজীবের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।
রাজীব তক্ষুণি উত্তর দিল না। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বলল, আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। উইমেন্স অর্গানাইজেশনের অ্যাক্টিভ মেম্বার হিসেবে আপনি মনোরমা দেবীকে না বলতে পারেন না। হিউম্যানিটারিয়ান গ্রাউন্ডে ওই হেল্পলেস মানুষগুলোকে শেলটার দেওয়াই উচিত। কিন্তু আপনার দুশ্চিন্তা আমাকে নিয়ে নিয়ে–তাই তো?’
সুবর্ণা আগেও লক্ষ করেছে, লোকটা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন থট রিডার। কেউ মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের কথা জেনে যায়। কিছু না বলে আস্তে মাথা নাড়ল সে। তবে আবছাভাবে এই প্রথম তার মনে হল, রাজীব শুধু একটা নিষ্ঠুর হননকারী নয়, তার মধ্যে দয়ামায়া সহানুভূতির মতো কোমল কিছু কিছু ব্যাপার এখনও থেকে গেছে।
রাজীব বলল, এক উইক পর মেয়েরা ছাড়া পাবে। এখনও অনেক সময় আছে। দু-একদিন ভেবে আপনাকে বলব।
সুবর্ণা আন্দাজ করল, নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সব দিক খুঁটিয়ে দেখার জন্য সময় নিল রাজীব। যদি বোঝে মেয়েরা এলে তার ক্ষতির আশঙ্কা নেই, সে সম্পূর্ণ। সুরক্ষিত থাকতে পারবে, তা হলে হয়তো আপত্তি করবে না।
সুবর্ণা বলল, তাই বলবেন। আপনার মতামত জানতে পারলে মনোরমাদিকে ফোন করব। আমি এখন যাচ্ছি। নিজের বেডরুমের দিকে চলে গেল সে।
.
১৩.
আরও তিনটে দিন কেটে গেল।
এর মধ্যে বিপজ্জনক বা চমকে দেবার মতো কিছুই ঘটেনি। যান্ত্রিক নিয়মে সুবর্ণা রোজ যা যা করে তাই করে গেছে। ঘুম থেকে উঠে শ্বশুর এবং দাদাশ্বশুরের সেবা, মেয়েকে পড়ানো, রাজীবের প্রতি আতিথেয়তা, কোথাও এতটুকু ত্রুটি হয়নি। তারপর স্নান করে, খেয়ে, মেয়েকে তার স্কুলে নামিয়ে, কলেজে চলে গেছে। ফিরে এসেও প্রায় একই রুটিন।
এর মধ্যে ওসি রামেশ্বর বসাক যথারীতি টেরোরিস্টের খোঁজে দিনে দু’বার করে ফোন করেছেন। বিমলেশ রাজীবের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। রোজই সে এ জন্য তাড়া দিয়ে চলেছে। সংগ্রামনারায়ণ রাজীব সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করেননি। তিনি সন্দেহমুক্ত হতে পেরেছেন কি না, মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না।
রাজীব ঘর থেকে প্রায় বেরোয়ই নি। সুবর্ণার লাইব্রেরি থেকে একের পর এক বই এনে পড়ে পড়ে সময় কাটিয়ে দিয়েছে। এ বাড়ি থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর ছকটা সে ঠিক করে ফেলতে পেরেছে কি না টের পাওয়া যায়নি। তবে তার চেহারায় বা কথাবার্তায় আগের সেই উগ্রতা ততটা নেই। হয়তো ভেবেছে, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ তার নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটবে না। কেউ তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার চেষ্টা করবে না।
মায়া অবশ্য একটা খবর দিয়েছিল। একদিন দুপুরে নাকি রাজীব ছাদে উঠে কী সব দেখে এসেছে।
এই ক’দিন সামান্যই একটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে রাজীবের ঘরে চার বেলাই তার খাবার টাবার দিয়ে আসতে হত। তার অনুরোধে দু’দিন ধরে রাতের খাওয়াটা হল-ঘরের ডাইনিং টেবলে বসে এক সঙ্গে খাচ্ছে সুবর্ণা।
.
আজ রাতেও তারা খেতে বসেছিল। পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। টেবলের দু’ধারে বসলে কথা বলতে সুবিধা হয়।
মায়া দু’জনের প্লেটে এবং বাটিতে বাটিতে রুটি, ছোলার ডাল, মুরগির মাংস, তরকারি ইত্যাদি সাজিয়ে দিয়ে কিচেনে চলে গিয়েছিল। রাজীবের সামনে পারতপক্ষে সে থাকতে চায় না। কিছু দরকার হলে তাকে ডাকতে হবে।
চুপচাপ খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণা। মানসিক ভারসাম্যহীন সেই নিরপরাধ মহিলারা ঠিক তিনদিন পর মুক্তি পাবে। অথচ তাদের থাকার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি। মনোরমাদি অনবরত ওদের এ বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য চাপ দিচ্ছেন। রাজীব বলেছিল, দু-একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে তার মতামত জানিয়ে দেবে। কিন্তু কিছুই জানায়নি। সুবর্ণা যে সাহস করে জিজ্ঞেস করবে, তাও পারেনি। লোকটা খুবই সন্দিগ্ধ ধরনের। যার খোঁজে পুলিশ খ্যাপা কুকুরের মতো চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরছে তার এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করলে যদি ভেবে বসে এর মধ্যে কোনও অভিসন্ধি আছে, সেই ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ বুজে থাকতে হয়েছে।
রাজীব টেবলের উলটো দিকে বসে বোধহয় লক্ষ করছিল। হঠাৎ বলল, মিসেস সিংহ, কী হয়েছে বলুন তো–
সুবর্ণা চমকে ওঠে, কই, কিছু না। আপনাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে।
হ্যাঁ, মানে–
কী?
সুবর্ণা এবার ঠিক করে ফেলল, রাজীব যা ভাবার ভাবুক, সে এখনই মেয়েগুলো সম্বন্ধে তার মত জেনে নেবে। বলল, সেদিন নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক ক’টা মেয়ের কথা বলেছিলাম। আপনি কিন্তু এখনও আমাকে কিছু জানাননি। তিন দিন পর ওরা ছাড়া পাচ্ছে। মনোরমাদি ভীষণ তাড়া দিচ্ছেন।
রাজীব বলল, ওদের কথা আমি যে ভাবিনি তা নয়। সেদিনই আপনাকে বলেছি হেল্পলেস মেয়েগুলোকে শেলটার দেওয়া উচিত।’ বলে একটু থামল। কী চিন্তা করে ফের বলল, ঠিক আছে, ওদের নিয়ে আসবেন। কিন্তু–
কিন্তু কী?
ওরা এলে আপনাদের অর্গানাইজেশনের অন্য ওয়ার্কাররাও নিশ্চয়ই আসবেন।