বাড়ির পেছন দিকের ওয়ার্কশপগুলোতে এখন প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততা। দু শিফটে ওখানে মেয়েরা কাজ করে। প্রথম শিফটটা সকালে সাতটায় শুরু, শেষ একটায়। দুপুর দু’টো থেকে আটটা পর্যন্ত যে শিফট, এখন সেটা চলছে। বাঁশ চেরাইর আওয়াজ, পেরেক ঠোকার আওয়াজ, তাতে চলার আওয়াজ, সব মিলিয়ে বিচিত্র অর্কেস্ট্রার মিশ্রিত শব্দ সেখান থেকে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মেয়েদের টুকরো টুকরো কণ্ঠস্বর।
মনোরমা দেবীকে কাছে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে আদর করতে করতে সস্নেহে বললেন, তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। কী খাবে বল?
দেবী লাজুক মুখে বলল, দুপুরে টিফিন খেয়েছি। এখন আর কিছু খাব না।
খাব না বললে শুনছি না। একটি মেয়েকে ডেকে দোকান থেকে সন্দেশ আর কাজু বাদাম কিনিয়ে এনে দেবীকে দিতে দিতে বললেন, তুমি খাও। আমি মায়ের সঙ্গে দরকারি কথা বলি- সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমাকে যে জন্যে কাল অত বার ফোন করেছিলাম সেটা শোন–
বলুন–উৎসুক চোখে তাকাল সুবর্ণা।
মনোরমা জানালেন, প্রতাপপুর সিটির বেশ কিছু মহিলা নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক অর্থাৎ নিরপরাধ পাগলকে দীর্ঘ দশ পনের বছর জেলে আটকে রাখার পর আসছে সপ্তাহে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এদের কারও মা-বাবা নেই। আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তারা কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোর দায়িত্ব নিতে চায় না। খবরটা পাওয়ার পর ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন মনোরমা। বললেন, এই হেল্পলেস মেয়েগুলোর জন্যে আমাদের কিছু একটা করা দরকার।
সুবর্ণা মনোরমাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। সে শুনেছে তার মা-বাবা দু’জনেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ইংরেজের জেলে তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টাই কেটে গেছে। স্বাধীনতার পর ইচ্ছা করলে তারা অনেক কিছুই পেতে পারতেন। তাম্রপত্র, অর্থ, মন্ত্রিত্ব এবং আরও অজস্র সুযোগ সুবিধা। কিন্তু তারা কিছুই নেন নি; রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে বাকি জীবন সমাজসেবা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। মা-বাবার সততা আর আদর্শবাদকে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন মনোরমা। তিনি ওঁদের একমাত্র সন্তান। কলেজে পড়ার সময় থেকেই সমাজকল্যাণে, বিশেষ করে লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্য কাজ করে চলেছেন। এম. এ পাশ করার পর কয়েক বছর রানী স্বর্ণময়ী কলেজে’-এ পড়িয়ে ছিলেন কিন্তু নির্যাতিত মেয়েদের সংখ্যা এত দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল যে চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিতে হল। মা-বাবার মৃত্যুর পর নিজেদের বাড়িতেই নারী বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তুললেন। এই সংগঠনটার জন্য শেষ পর্যন্ত বিয়ে করারও সময় পান নি।
নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর জন্য নিজের যা কিছু সবই দিয়েছেন মনোরমা। গভর্নমেন্ট থেকে কিছু গ্রান্ট পাওয়া যায়, বিদেশ থেকেও ডোনেশন আসে। বড় বড় বিজনেস হাউস তাদের সোশাল ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে কিছু টাকা দেয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের ছোট ছোট দান তো আছেই। এই সব গ্রান্ট ট্রান্ট জোগাড় করতে কত জায়গায়, কত প্রভাবশালী লোকের কাছে যে ছোটাছুটি করতে হয়েছে তার হিসেব নেই।
এই বিশাল কাজ তো একা করা সম্ভব নয়। তাই সুবর্ণার মতো আরও অনেককেই নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ টেনে এনে নানা দায়িত্ব দিয়েছেন।
এতদিন নির্যাতিত মেয়েদের জন্য জীবনের সব কিছু অর্থাৎ ব্যক্তিগত সুখ, আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। এখন নতুন করে যুক্ত হল নিরপরাধ পাগল মেয়েরা। ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারলে যেন জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে মনোরমার।
সুবর্ণা বলল, নিশ্চয়ই কিছু করতে হবে।
মনোরমা বললেন, কিন্তু একটা সমস্যা আছে। সেই জন্যেই তোমাকে কাল ফোন করেছিলাম।
সমস্যাটা কী?
এত মেয়ে কোথায় রাখব? নারী বিকাশ কেন্দ্র’ তো বোঝাই। এখানে আর জায়গা নেই।
সুবর্ণাকে চিন্তিত দেখায়। সে বলে, তা হলে কী করবেন?
মনোরমা বলল, একটাই সলিউসন রয়েছে। তবে সেটা পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভর করছে।
উৎসুক সুরে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, আমি কী করে সলভ করব?
তোমাদের প্যালেসের একতলায় অনেকগুলো ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। যতদিন না অন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে ওখানে যদি ওদের থাকতে দাও’ বলতে বলতে চুপ করে গেলেন মনোরমা।
সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে বলে, আমার নিজের আপত্তি নেই কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের পারমিসন ছাড়া তো কিছুই করা যাবে না মনোরমাদি।
মনোরমা বললেন, খুব বেশিদিন ওরা থাকবে না। ম্যাক্সিমাম একমাস। তার মধ্যেই ওদের জন্যে একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলব। খাওয়া টাওয়ার যা খরচ, আমাদের অর্গানাইজেশনই দেবে। রান্নার লোকও আমরা পাঠাব। তুমি শ্বশুরমশাইকে একটু বুঝিয়ে বলো। তুমি বললে আশা করি উনি না’ বলবেন না।
আচ্ছা বলব।’বলতে বলতে রাজীবের মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সুবর্ণার। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড দুর্ভাবনা তাকে গ্রাস করে। শুধু সংগ্রামনারায়ণের অনুমতি নিলেই চলবে না, রাজীবের মতামতই সব থেকে জরুরি। তার আপত্তি থাকলে একটা মাছিকেও ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢোকানো যাবে না। সে মনস্থির করে ফেলল, প্রথমে রাজীবকে বুঝিয়ে বলবে। তারপর সংগ্রামনারায়ণের কাছে যাবে।
বাড়ি ফিরে দেবীকে নিজেদের বেডরুমে পাঠিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে এল সুবর্ণা।