তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। বললেন তবে কী?
ভীষণ ঘাবড়ে যায় সুবর্ণা। এক রকম মরিয়া হয়েই বলে, আমি অত ভাল জানি না। বৌদির মুখে শুনেছিলাম, ওর পিসিমার ওদিকেই কোথায় যেন বিয়ে হয়েছে।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না সংগ্রামনারায়ণ। শুধু বললেন, আজ দুপুরে তুমি যখন কলেজে, রাজীবের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করলাম। এমনি বেশ ভদ্র। ওকে বললাম, নতুন জায়গায় এসেছ, সারাক্ষণ ঘরে বসে আছ কেন? আমাদের ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, সে তোমাকে গাড়িতে করে প্রতাপপুর সিটি, লেকটেক ঘুরিয়ে দেখাবে। রাজীব রাজি হল না। বলল, ভীষণ টায়ার্ড। দু-একদিন রেস্ট নিয়ে নিজেই ঘুরেটুরে দেখবে। পায়ে হেঁটে না ঘুরলে নাকি কোনও নতুন জায়গা ভাল করে দেখা হয় না। আমি বললাম, তবে তাই দেখো–’
শ্বাস আটকে গিয়েছিল সুবর্ণার। কোনওভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সে।
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বাবার ঘরে আমাদের টেলিফোনটা দেখলাম।
তিনি যে এটাও লক্ষ করবেন ভাবতে পারেনি সুবর্ণা। কাঁপা গলায় কোনওরকমে জানাল, সে নিজে সারাক্ষণ বাড়িতে থাকে না, কলেজে বেরুতে হয়। এদিকে রাজীবের কটা জরুরি ফোন আসার কথা আছে। তাই ওটা শেীর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে রেখে এসেছে।
সংগ্রামনারায়ণ কয়েক পলক কী ভেবে বললেন, ভালই করেছ।
কথায় কথায় সন্ধে নেমে গিয়েছিল। সুবর্ণা ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। নিজের ঘরে এসে দেবীকে পড়তে বসিয়ে দিল। আর তখনই মনে পড়ে গেল, নিচে গিয়ে হরেনের সঙ্গে রাজীব সম্পর্কে কথা বলতে হবে। কিন্তু তার আগে রাজীবকে সেটা জানানো দরকার। ওই সশস্ত্র টেরোরিস্টটা এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে সুবর্ণার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছুই আর কাজ করে না। নিজের থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই তার নেই। সে কোথায় যাবে, কেন যাবে, কার সঙ্গে কী কথা বলবে–সমস্ত কিছুই নির্ভর করছে ওই লোকটার অনুমতির ওপর। সর্বক্ষণ তার মনে হয়, অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোলে সে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তুই পড়। আমি এক্ষুণি একটা কাজ সেরে আসছি।’ এক নিঃশ্বাসে দেবীকে কথাগুলো বলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে এল সুবর্ণা।
কলোনিয়ালিজমের ওপর সেই বইটা পড়ছিল রাজীব। সুবর্ণাকে দেখে উৎসুক চোখে তাকাল।
সুবর্ণা বলল, তখন একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
রাজীব জিজ্ঞেস করল, কী কথা?
হরেনের ব্যাপারটা জানিয়ে সুবর্ণা বলল, ওকে এখন গিয়ে বোঝাতে হবে আপনার সম্পর্কে যেন চুপচাপ থাকে, কারও কাছে মুখ না খোলে।
ঠিক আছে। আপনারা যখন কথা বলবেন আমি কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের পিলারটার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনব।
আচ্ছা।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর রাজীব বলল, আমার মাথার ওপর পঞ্চাশ লাখ টাকার পুরস্কার রয়েছে। টাকার মতো খারাপ জিনিস আর নেই। লোভে পড়ে হরেন ডেসপারেটলি কিছু করে বসবে না তো?
সুবর্ণা বলল, হরেন খুবই বিশ্বাসী, কিন্তু ওর মতো ভীরু আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তবু ভাল করে বুঝিয়ে দেবো, টাকার জন্যে বেপরোয়া হলে তার ফল কী হবে।
রাজীব উত্তর দিল না।
.
১২.
পরদিন কলেজ ছুটির পর একটা সাইকেল রিকশা নিল সুবর্ণা দেবীকে তার স্কুল থেকে তুলে সোজা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সামনে এসে থামল।
মহারানী হেমপ্রভা অ্যাভেনিউতে মনোরমা অধিকারীদের বিশাল তেতলা বাড়ি। গোটা বাড়ি জুড়েই নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিস এবং কর্মশালা। দুঃস্থ, স্বামী পরিত্যক্ত, ধর্ষিত বা নানাভাবে নির্যাতিত যে মেয়েদের আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, তাদের সযত্নে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন মনোরমা। তিনিই এদের শেষ আশ্রয়।
বাড়িটার পেছন দিকে অনেকখানি কঁকা জায়গা। অসহায় মেয়েগুলো যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে, ভাত-কাপড়ের জন্য তাদের কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়, সে জন্য ওখানে বড় বড় টিনের শেড তুলে কোনওটায় তাঁত বসানো হয়েছে। কোনওটায় বেত, বাঁশ, কোনওটায় বা চামড়ার কাজের জন্য রয়েছে ওয়ার্কশপ। এখানকার মেয়েদের তৈরি শাড়ি, নকশা-করা চাদর, টেবল ক্লথ, বেতের মোড়া বা চেয়ার, চামড়ার ব্যাগ, ঘর সাজানোর নানা জিনিস আর বটুয়ার বিরাট চাহিদা। শুধু প্রতাপপুরেই নয়, শিলিগুড়ি, কলকাতা, এমন কি সুদূর দিল্লি থেকেও ভাল অর্ডার আসে। ফলে আর্থিক দিক থেকে মেয়েরা অনেকখানি নিশ্চিন্ত। তাদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেবীকে নিয়ে একতলায় নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসে চলে এল সুবর্ণা।
মনোরমা টেবলের ওপর ঝুঁকে কিছু লিখছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে একটু হেসে বললেন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আরে দেবীকেও এনেছ!’
মনোরমার বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। সময় এলোপাথাড়ি ব্রাশ চালিয়ে তার চুল আধাআধি সাদা করে দিয়েছে। শরীর কিছুটা ভারী। চেহারায় যৌবনের পেলবতা মুছে গিয়ে রুক্ষতা ফুটে উঠেছে। তবু ডিম্বাকৃতি মুখ, ধারাল নাক, বড় বড় উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, অনেকটা মলিন হয়ে গেলেও ফর্সা রং, সব মিলিয়ে বলা যায় একসময় তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন।
একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে সুবর্ণা বলল, আসার সময় পথে ওর স্কুলটা পড়ল, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনোরমার সঙ্গে একটু মিথ্যাচারণই করল সে। রাজীবের জন্য ইদানীং যে দেবীকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছে এবং ছুটির পর নিয়ে আসছে সেটা আর বলল না।