মনোরমা জিজ্ঞেস করলেন, তবে কী?
কাল যেতে পারব কিনা, বুঝতে পারছি না। কবে যাব, আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেবো।
আসলে রাজীবের সঙ্গে কথা না বলে সুবর্ণার পক্ষে আপাতত কথা দেওয়া সম্ভব নয়। তার স্বাধীনতা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পুতুলনাচের পুতুলের মতো তার হাতে পায়ে অদৃশ্য সুতো বাঁধা রয়েছে। আর সেই সুতোর ডগাগুলো রয়েছে রাজীবের আঙুলে জড়ানো। সে যেভাবে তাকে চালাবে, অবিকল সেভাবেই তাকে চলতে হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের কলেজ আর দেবীর স্কুলে যাওয়া এবং ছুটির পর বাড়ি ফিরে আসা-এর মধ্যেই তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে রাজীব। তাকে না জানিয়ে ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ গিয়ে যদি দেরি হয়ে যায়, রাজীব তার মধ্যে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পেতে পারে। ভাবতে পারে তাকে বিপদে ফেলার জন্য কিছু একটা হোড়জোড় করছে সুবর্ণা। লোকটা এতই সন্দেহপ্রবণ যে সে কলেজে আছে কি না সে খোঁজও দু-তিন বার ফোন করে আজ নিয়েছে।
মনোরমা ব্যস্তভাবে বললেন, দেরি করলে চলবে না। কালই তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব আর্জেন্ট।
মিনিট পনের বাদে আপনাকে ফোন করছি। মনোরমাকে কিছু বলার সময় না দিয়ে লাইন কেটে দেয় সুবর্ণা।
আগাগোড়া তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিল রাজীব। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল, মনে হচ্ছে আপনার মনোরমাদি আপনাকে কোনও একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে সুবর্ণা, হ্যাঁ।
রাজীবের চোখেমুখে ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে, প্রবলেমটা কী?
মনোরমা কী বলেছেন তা জানিয়ে দিল সুবর্ণা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু ভাবল রাজীব। তারপর বলল, ঠিক আছে, কাল কলেজ ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ গিয়ে আপনার মনোরমাদির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। আশা করি, আপনাদের পারিবারিক নিরাপত্তার ব্যাপারে যে ওয়ার্নিংগুলো কাল থেকে বার বার দিয়ে আসছি সেগুলো ভুলে যাবেন না।
সংগ্রামনারায়ণ এবং শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ যে তার হোস্টেজ হয়ে আছেন; সুবর্ণা মনোরমার সঙ্গে দেখা করে তার বিরুদ্ধে কোনওরকম গোলমাল পাকানোর চেষ্টা। করলে এঁদের পরিণতি কী হতে পারে, সেটাই আরেক বার মনে করিয়ে দিল রাজীব। স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলল, না, ভুলব না। আমি তা হলে মনোরমাদিকে ফোন করে কাল দেখা করার কথাটা বলে দিচ্ছি।
বলুন।
সুবর্ণা মনোরমাকে আরেক বার ফোন করল। কথা শেষ করে ফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে রাজীবকে বলল, আমি এখন যাচ্ছি। কলেজ থেকে ফেরার পর এক কাপ চাও খাওয়া হয় নি। বলে একটু হাসল।
রাজীব ব্যস্তভাবে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, যান।
নিজের ঘরে চলে এল সুবর্ণা। কচুরি তরকারি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কোনওরকমে খেয়ে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে এল।
চেক লেখা হয়ে গিয়েছিল। সুবর্ণার হাতে সেটা দিয়ে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বসো বৌমা–
একটা পুরু গদিওলা মোড়া খাটের কাছে টেনে এনে সুবর্ণা বসে পড়ল।
সংগ্রামনারায়ণ সামনের বিশাল জোড়া জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলেন। সন্ধে হতে খুব বেশি দেরি নেই। সূর্য পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু গাছপালার মাথায় ফ্রিজ শটের মতো স্থির হয়ে রয়েছে। যে নিস্তেজ আলোটুকু এখনও আকাশের গায়ে আবছাভাবে লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে যাবে, ঝুপ করে নেমে আসবে অঘ্রাণের সন্ধে। অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চোখের সামনে দৃশ্যমান প্রতাপপুর সিটির বাড়িঘর, রাস্তা, পার্ক।
একটু লক্ষ করলে এখন চোখে পড়ে, দূরে মিহি সিল্কের মতো কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। হাওয়া দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
সুবর্ণা বুঝতে পারল, জরুরি কথাটা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন সংগ্রামনারায়ণ। সে অপেক্ষা করতে লাগল। মনে মনে কিছুটা টেনসন যে হচ্ছিল না তা নয়। কী বলবেন সংগ্রামনারায়ণ? রাজীব সম্পর্কেই কি কিছু?
একসময় সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে সংগ্রামনারায়ণ বললেন তোমার যে আত্মীয়টি এসেছে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না।
যা আন্দাজ করা গিয়েছিল তা-ই। শ্বাসক্রিয়া যেন পলকের জন্য বন্ধ হয়ে গেল সুবর্ণার। নিঃশব্দে সে সংগ্রামনারায়ণকে লক্ষ করতে থাকে। রাজীব সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলে তাকে খুবই সমস্যায় পড়তে হবে।
সংগ্রামনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আত্মীয়টি তোমার বৌদির কিরকম যেন ভাই হয়?
সংগ্রামনারায়ণ কি তাকে পরীক্ষা করতে চাইছেন? একটু হকচকিয়ে গেলেও সুবর্ণা টের পায় তার স্মৃতিশক্তি এখনও যথেষ্ট সক্রিয়। চাপা গলায় বলল, পিসতুতো ভাই।
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার বৌদির পিসিমার কি আসাম বা নর্থ-ইস্টের অন্য কোনও স্টেটের লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল?
সুবর্ণা চমকে ওঠে, এ কথা জানতে চাইছেন কেন বাবা?’
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তুমি রাজীবের চেহারা আর বাংলা উচ্চারণ লক্ষ করেছ?
তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন তা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। তবু বলল, হ্যাঁ, মানে–কেন বলুন তো?
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, ওর মুখেচোখে একটা মঙ্গোলিয়ান ছাপ রয়েছে না? বাংলা প্রোনানসিয়েসনও পারফেক্ট নয়। তাই মনে হচ্ছে তোমার বৌদির পিসিমার বিয়েটা হয়তো নর্থ-ইস্টেই হয়েছে।
সুবর্ণার গলা শুকিয়ে আসছিল। সংগ্রামনারায়ণ রাজীব সম্পর্কে পুরোপুরি সংশয় মুক্ত হতে পারেন নি, সন্দেহটা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল সুবর্ণার। ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি অত ভাল জানি না। তবে এরপর কী বলবে, ভেবে নেওয়ার জন্য থেমে গেল সে।