সুবর্ণা দেবীকে বলল, ঘরে গিয়ে স্কুল ড্রেসটা চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি মায়াকে খাবার দিতে বলে আসি। মেয়েকে বেডরুমে পাঠিয়ে সে কিচেনে চলে গেল।
রোজই এই সময় বিকেলের খাবার তৈরি করে মায়া। একেক দিন একেক রকম। কোনওদিন পরটা, আলুর দম। কোনও দিন টোস্ট, ঘুগনি। কোনও দিন লুচি, পায়েস। বিকেলে সংগ্রামনারায়ণ আর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ হরলিকস আর বিস্কুট ছাড়া কিছু খান না, ডাক্তারের বারণ। খাবার যা হয় সবই সুবর্ণা আর দেবীর জন্য। অবশ্য মায়াও খায়।
কিচেনে এসে সুবর্ণা দেখল, কচুরি ভাজার তোড়জোড় করছে মায়া। সতর্কভাবে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কোনও গোলমাল হয়নি তো?
প্রশ্নটার উদ্দেশ্য মায়ার কাছে পরিষ্কার। সে বলল, না, তবে ছোট বাবা বার কয়েক হল-ঘরে এসে লোকটাকে দেখে গেছেন।
সুবর্ণার মনে পড়ল, কলেজ থেকে যখন সে ফোন করেছিল তখন রাজীবও এই কথাগুলো জানিয়েছিল।
মায়া ফের বলল, একবার ছোট বাবা খানিকক্ষণ কথাও বলল লোকটার সঙ্গে। সুবর্ণা চমকে উঠল, কী কথা?
বলতে পারব না। আমি রান্নাঘরের দরজা ফাঁক করে বসেছিলাম। এতদূর থেকে কি শোনা যায়?
বাবা রাগারাগি চেঁচামেচি করেননি তো?
না।
দুশ্চিন্তা একটু কাটল ঠিকই, তবে মনের ভেতর সামান্য খিচ থেকে গেল। সুবর্ণা বলল, তুমি তাড়াতাড়ি সবার খাবার নিয়ে এসো।
নিজের ঘরে আসতেই তার চোখে পড়ল, দেবীর মুখটুখ ধোয়া হয়ে গেছে। সুবর্ণাও দ্রুত শাড়িটাড়ি পালটে, বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এল।
কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এল মায়া। দেবীকে খেতে দিয়ে, নিজের কচুরি তরকারি ঢাকা দিয়ে রেখে প্রথমে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে গেল সুবর্ণা। হরলিকসের গ্লাস, বিস্কুট, চারটে ট্যাবলেট আর জল খাটের পাশের একটা সাইড টেবলে গুছিয়ে দিয়ে বলল, বাবা, খেয়ে নেবেন। আমি যাচ্ছি—
সংগ্রামনারায়ণ তাঁর খাটের মাঝখানে চেক-বই নিয়ে বসে ছিলেন। প্রতি মাসের প্রথম এবং তৃতীয় সপ্তাহে দু’বার খরচের জন্য চেক লিখে তিনি সুবর্ণাকে দেন। সে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিয়ে আসে। বললেন, বৌমা, তোমার সঙ্গে কিছু আলোচনা আছে।
দাদাভাইকে খাইয়ে আসছি। খাবার নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে এসে কচুরির প্লেটটা রাজীবকে দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে ধরে জোর করে ডিভানে বসিয়ে হরলিকস খাওয়াতে শুরু করল সুবর্ণা। জিজ্ঞেস করল, আমার কি আর কোনও ফোন এসেছিল?’
রাজীব বলল, হ্যাঁ। থানা থেকে আরও কয়েক বার খোঁজখবর নিয়েছে। আর আপনাদের অর্গানাইজেশনের সেই মনোরমা অধিকারীও খানিকক্ষণ আগে আবার ফোন করেছিলেন। আপনি কলেজ থেকে ফিরলেই কনট্যাক্ট করতে বলেছেন।
সুবর্ণা বলল, ঠিক আছে।
রাজীব হাতের বইটা সোফার একধারে রাখতে রাখতে বলল, আপনার পারমিসন না নিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি মিসেস সিংহ।’ বলে অল্প হাসল।
সুবর্ণা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, কারও পারমিসন নেওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?
তার কথার মধ্যে যে তীব্র ধাক্কাটা ছিল সেটা লক্ষই করল না রাজীব। সোফায় যে বইটা রেখেছিল সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, সময় কাটছিল না বলে আপনার লাইব্রেরি থেকে এটা নিয়ে এসেছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং বুক–’মেনি ফেসেস অফ কলোনিয়ালিজম। এমন বই আগে কখনও পড়িনি। বইটা সবার পড়া উচিত।
ইংরেজরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে কলোনিয়ালিজমও শেষ। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর আর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর জিজ্ঞেস করে, ইন্ডিয়ায় কলোনিয়ালিজম শেষ হয়ে গেছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল সুবর্ণা, আপনি কি বিশ্বাস করেন না?
একটু চুপ করে থেকে রাজীব বলল, সারাদিন কলেজ করে এসেছেন। নিশ্চয়ই ভীষণ টায়ার্ড। তার ওপর শ্বশুর আর দাদাশ্বশুরের সেবা করতে হচ্ছে। পরে কোনও একদিন কলোনিয়ালিজম ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
সুবর্ণা জবাব দিল না। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়া শেষ হলে মনোরমা অধিকারীকে ফোন করল।
মনোরমা তাদের মহিলা সমিতি নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসেই ছিলেন। বললেন, তোমাকে আজ দু’বার ফোন করেছি, পাইনি।
সুবর্ণা বলল, শুনেছি। কিন্তু ওই সময় তো আমি কলেজে থাকি। বাড়িতে পাবেন কী করে?
আরে তাই তো, আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না। শোন, তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।
বলুন না—
মনোরমা বললেন, ফোনে বলা যাবে না। তুমি কি কাল কলেজ ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসে আসতে পারবে? অসুবিধা থাকলে আমিও তোমাদের বাড়ি যেতে পারি।
মনোরমার ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে আসাটা ঠিক হবে না। এখানে এলে রাজীবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কেননা বাইরের যে কয়েক জন। সংগ্রামনারায়ণের আগাম অনুমতি না নিয়ে সোজা দোতলায় উঠতে পারে, মনোরমা তাদের মধ্যে পড়েন। যদি সত্যিই তিনি আসেন আর বুঝতে পারেন রাজীব সুবর্ণাদের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, তিনি ছাড়বেন না। আসলে মহিলা অত্যন্ত তেজী এবং খানিকটা বেপরোয়াও। যেভাবে হোক রাজীবের হাত থেকে তাদের মুক্ত করতে চাইবেন। কিন্তু তার ফলাফল ভয়াবহ হতে বাধ্য।
সুবর্ণা ত্রস্তভাবে বলল, না না, আপনাকে আসতে হবে না। আমিই যাব। তবে–