বেশ। তাই বলো—
কিন্তু–
কী?
তুমি ওই লোকটার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছ কেন?
দু’টো কারণে। প্রথমত বুঝতে চেষ্টা করব পুলিশ যদি হঠাৎ কোনও কু পেয়ে ওকে ধরার জন্য প্যালেসে হানা দেয়, ও তোমাদের কতটা ক্ষতি করতে পারে। দ্বিতীয় কারণটা তাত্ত্বিক বলতে পার। আমরা নিজেদের দেশের মধ্যে থেকেই সিস্টেম বদলের কথা ভেবেছিলাম। ওরা ইন্ডিয়া থেকে কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় সেটা জানতে চাইব।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিমলেশ আবার বলল, ইন ফ্যাক্ট, আগে কখনও কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ওদের সম্পর্কে আমার যথেষ্ট কৌতূহল আছে।
কৌতূহল কতটা মিটবে জানি না। এখন বলো আমি কী করব?
কিছুক্ষণ ভেবে বিমলেশ বলল, আপাতত ক’টা দিন যেমন চলছে চলুক। আমিও ভাবি, তুমিও চিন্তা কর। ওর হাত থেকে মুক্তির একটা পথ নিশ্চয়ই বেরিয়ে যাবে।
১১. বিমলেশের ফ্ল্যাট থেকে
১১.
বিমলেশের ফ্ল্যাট থেকে সোয়া চারটেয় বেরিয়ে পড়ল সুবর্ণা। দেবীর স্কুল এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একটা ফাঁকা সাইকেল রিকশা থামিয়ে উঠে পড়ল সে। দেবীকে নিয়ে এই রিকশাতেই সোজা বাড়ি ফিরে যাবে। আজ আর মেয়েদের অর্গানাইজেশনে যাওয়া হবে না! কাল সময় করে একবার যাওয়ার চেষ্টা করবে।
বিমলেশ তাকে রাজীবের হাত থেকে মুক্তির কোনও রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারেনি। শুধু ধৈর্য ধরে তার ওপর লক্ষ রাখতে বলেছে। এছাড়া উপায়ই বা কী? ধৈর্য, অন্তহীন ধৈর্য। তার সঙ্গে সুকৌশলে মেশাতে হবে যাবতীয় বুদ্ধিমত্তাকে। অপরিসীম দুর্ভাবনার মধ্যেও ক্ষীণ আশার চকিত একটা রেখা যেন দেখা দিল। বিমলেশের সঙ্গে রাজীবের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারলে হয়তো কাজের কাজ কিছু একটা হতে পারে। বিমলেশ অত্যন্ত দুঃসাহসী, মস্তিষ্ক আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা। প্রতিপক্ষের ভাবগতিক বুঝে হাসি মুখে পালটা গলে তাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারে। সুবর্ণাদের পরিবারের স্বার্থে দু’জনের আলাপ হওয়া একান্ত জরুরি। কিন্তু কীভাবে?
অল্পবয়সী রিকশাওলাটা গাড়ি চালাতে চালাতে কল, বৌদি–
এই শহরের বেশির ভাগ রিকশা, অটো আর টাকা সুবর্ণাকে চেনে। চোদ্দ বছরে এদের সবার গাড়িতে কতবার যে সে চড়েছে তার হিসেব নেই। ওরা যেমন তাকে চেনে, সে-ও তেমনি ওদের সবাইকে চেনে, এমনকি অনেকের নামও তার। জানা।
সুবর্ণা একটু চমকে উঠে বলে, কি রে ভানু?
আপনাদের রাজবাড়িতে নাকি একটা খুনী ঢুকে আছে?
কে বলল?
সবাই। কাগজে খবরটা বেরিয়েছে; খুনীর একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। আপনি দেখেননি বৌদি?
বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, হত্যাকারী হিসেবেই তা হলে রাজীবের নামটা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে! একটু চুপ করে থেকে সুবর্ণা বলল, দেখেছি।
প্যাডল করতে করতে আঁতকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ভানু, দেখেছেন!
হ্যাঁ, ছবিতে। সুবর্ণা বলল, আমাদের বাড়িতে ওরকম কেউ ঢোকেনি।
বিহ্বলের মতো কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ভানু বলল, কিন্তু সবাই যে বলছে।
সুবর্ণা বলল, সত্যিই যদি ঢুকত আমি কি বেঁচে থাকতাম?
এবার যেন বিশ্বাস হল ভানুর। তা তো ঠিকই–’বলতে বলতে ফের সামনের দিকে তাকায়।
দেবীর স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সবে ছুটি হয়েছে। ওকে রিকশায় তুলে বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে পাঁচটা বেজে গেল।
গেটের সামনে হরেন দাঁড়িয়ে ছিল। সাইকেল রিকশা থেকে নেমে দেবীকে নিয়ে সুবর্ণা যখন বাড়ির দিকে যাচ্ছে, সে-ও ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
সুবর্ণার মনে হল, হরেন কিছু বলতে চায়। সে কোনও প্রশ্ন করল না। তার ইচ্ছা হরেন নিজের থেকে বলুক। তার চোখ মুখের চেহারা সুবর্ণাকে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন করে তুলল।
দরজার কাছাকাছি এসে নিচু গলায় হরেন বলে, বৌদি, একটা কথা বলবার ছিল।
সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ, বলো না—
দুপুরে দোতলায় অচেনা লোকের গলা শুনতে পেলাম।
সুবর্ণা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একটু চিন্তা করে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওপরে গিয়েছিলে নাকি?
হরেন বলল, না না। নিচে বসেই কানে এল। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে, তাছাড়া যেখানে যাচ্ছি, লোকজন বলাবলি করছে একটা সাঙ্ঘাতিক খুনী নাকি কাল রাত্তিরে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। গলাটা তারই কিনা–বলতে বলতে থেমে যায় সে।
একজন সন্ত্রাসবাসী হত্যাকারীর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কাল রাত্তিরে ঢুকে পড়ার গুজব চারিদিকে যে চাউর হয়ে গেছে সেটা রিকশাওলা ভানু আর কলেজের কলিগদের নানা প্রশ্নে টের পাওয়া গিয়েছিল।
বিমলেশ ছাড়া অন্য সবার কাছেই ঘটনাটা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে সুবর্ণা। কিন্তু হরেন এ বাড়িতে থাকে। সে নিশ্চয়ই রাজীবের গলা শুনেছে। হঠাৎ কখনও ওকে দেখেও ফেলতে পারে। হরেনের কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখা ঠিক হবে না। তাকে খোলাখুলি সব জানিয়ে সাবধান করে দেওয়াটা খুবই জরুরি।
সুবর্ণা চাপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু দরকারি কথা আছে। বলুন বৌদিদি’। এখন না, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর বলব। আমি কি ওপরে যাব?
না। আমিই নিচে আসব।
সুবর্ণা আর দাঁড়াল না, দেবীকে নিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে দেখতে পেল শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তার ঘরে বাচ্চাদের মতো টলমল করতে করতে হাঁটছেন আর সিঁড়ির দিকে মুখ করে সোফায় বসে কী একটা বই পড়ছে রাজীব। পায়ের শব্দে দ্রুত চোখ তুলে তাকাল সে। ততক্ষণে দোতলায় চলে এসেছে সুবর্ণারা। ওদের দেখেও সে কিছু বলল না।