এখানে আরও অনেক বার এসেছে সুবর্ণা। তিন কামরার এই ফ্ল্যাটের বেডরুম, ড্রইংরুম, কিচেন, বিমলেশের পড়ার ঘর–কোথায় কী আছে তার সব মুখস্থ।
বিমলেশ আর সুবর্ণা ড্রইংরুমে এসে বসল। বিমলেশ বলল, আগে একটু কফি খেয়ে নেওয়া যাক, কী বল?
সুবর্ণা বলল, ঠিক আছে।
পবনকে ডেকে কফি করে আনতে বলল বিমলেশ।
পবন কাজেকর্মে খুবই চৌকস। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুধু কফিই না, সেই সঙ্গে কেক আর কাজু বাদামও এসে গেল।
কফিতে চুমুক দিয়ে বিমলেশ বলল, শুরু করো।
কাল সন্ধে থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, একটানা বলে গেল সুবর্ণা। সমস্ত ব্যাপারটা এতটাই ভীতিকর যে ড্রইমরুমটায় দম বন্ধ করা আবহাওয়ার সৃষ্টি করল। চমকপ্রদ রহস্য কাহিনীতেও এমন শ্বাসরোধী ঘটনাপ্রবাহ থাকে না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে লোকটা কী জন্যে এই প্রতাপপুর সিটিতে পালিয়ে এল, কিছু বলেছে? ওখানকার বেশির ভাগ স্টেটেই আর্মি আর প্যারামিলিটারি ফোর্স নামানো হয়েছে। তাদের তাড়া খেয়েই কি?
সুবর্ণা বলল, কিছুই বলতে পারব না। লোকটা শুরুতেই শাসিয়ে রেখেছে তার সম্বন্ধে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ বা প্রশ্ন করা চলবে না। যার সঙ্গে ডেডলি ওয়েপন আছে, তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো দুঃসাহস আমার নেই।
বিমলেশ বলল, এখন পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় যা যা করেছ, প্রচণ্ড নার্ভের জোর আর ইনটেলিজেন্স না থাকলে তা করা সম্ভব নয়।
প্রশংসার কথাগুলো শুনেও যেন শুনল না সুবর্ণা। শেষ রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত তার বুদ্ধিমত্তা বা স্নায়ুর জোর প্রমাণিত হবে কীভাবে? মাত্র কয়েক ঘণ্টা তো কেটেছে। যদি রাজীব কয়েক দিন থেকে যায়, স্নায়ুমণ্ডলী কি অক্ষত থাকবে? মনের জোর বা সঠিকভাবে মস্তিষ্ক খাটানোর কাজটা কি অটুট রাখা সম্ভব হবে? সে বলে, কাল সন্ধে ছ’টা থেকে আজ বিকেল তিনটে পর্যন্ত, মাত্র একুশটা ঘন্টা তো কাটল। লোকটা কতদিন আমাদের হোস্টেজ করে বাড়িতে থেকে যাবে জানি না। কেউ ভয়ে হঠাৎ কিছু করে বসলে আমরা একজনও বেঁচে থাকব না। এদিকে ওসি-কে বলেছি, আমাদের বাড়িতে কেউ ঢোকেনি। তিনি কতটা বিশ্বাস করেছেন জানি না। মাঝে মাঝেই ফোন করছেন। প্যালেসের ওপর ওয়াচ রাখার জন্য প্লেন ড্রেসের পুলিশ লাগিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থায় আমার কী করা উচিত বলতে পারো?
তোমার একার না, বাড়ির প্রতিটি লোকের একমাত্র কাজ হল সারাক্ষণ মাথা ঠান্ডা রাখা। টেরোরিস্টটাকে খুব কেয়ারফুলি হ্যান্ডল করতে হবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর বিমলেশ বলল, কাগজে দেখলাম লোকটা সেসেসানিস্ট–বিচ্ছিন্নতাবাদী। ভারতবর্ষ থেকে ওরা আলাদা হয়ে ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেট করতে চায়। ওর সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহ হচ্ছে।
সুবর্ণা আঁতকে ওঠে, কেন?
বিমলেশ বলল, দেখ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় উগ্রপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেসব তোমাকে বলেছি। স্বপ্ন দেখেছিলাম দেশ শোষণ থেকে মুক্তি পাবে, সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি বদলে যাবে। বিশ্বাস করতাম, রাইফেলের নল ছাড়া এসব কিছুই করা যাবে না। এক্সপ্লয়টেশনের অধিকার কেউ, সহজে ছাড়তে চায় না। আমার এখনও ধারণা, সোশাল সিস্টেমকে পালটাতে হলে ভায়োলেন্স ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা বোধ হয় নেই।’
সুবর্ণার মনে পড়ল, বেশ কয়েক বছর আগে তাদের বন্ধুত্বটা যখন শুধু আড্ডা আর ফাজলামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নির্ভরতা এবং আস্থার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সেই সময় একদিন বিমলেশ তার জীবনের অনেক কথাই বলেছিল। সে একজন বড় মাপের স্বপ্নদর্শী, একজন আইডিয়ালিস্ট। ভাল রেজাল্ট করে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে আই. এ. এস, আই. পি. এস হব, বা মাল্টিন্যাশনাল কোনও কোম্পানির টপ একজিকিউটিভের পোস্ট বাগাব, কিংবা আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া কি জার্মানিতে গিয়ে বিশাল কেরিয়ার তৈরি করব–এসব তার ভাবনার মধ্যে কখনও ছিল না স্বাধীনতার পর কিছু লোকের ঘরে টাকার পাহাড় জমতে লাগল, দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেল দেশের শতকরা ষাট ভাগ মানুষ, ভ্রষ্টাচারে ছেয়ে গেল সারা ভারতবর্ষ, আদর্শবাদ আর মানবিক মূল্যবোধগুলোকে গলা টিপে শেষ করে দেওয়া হল। পচা, গলা, দুর্গন্ধওলা সোশাল সিস্টেম দেশকে ধ্বংসের কাছাকাছি যখন পৌঁছে দিয়েছে সেই সময় বিমলেশ এবং তার মতো অসংখ্য তরুণ হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিল। তাদের ধারণা সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া সিস্টেমকে। ভাঙা যাবে না। তারপর অনেক দিন কেটে গেল। তাদের স্বপ্নপূরণ হয়তো হয়নি। তবু সেদিনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের অনেকখানি এখনও তার মধ্যে থেকে গেছে। তবে এখন আর সে অ্যাক্টিভিস্ট নয়, সক্রিয়ভাবে কিছুই করে না। বিশ্বাসটুকু বাদ দিলে ছাত্রছাত্রীই তার কাছে সব। সুবর্ণা ছাড়া তার মতো জনপ্রিয় অধ্যাপক রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ আর একজনও নেই।
বিমলেশ বলল, আমার সঙ্গে লোকটার আলাপ করিয়ে দাও না–
জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সুবর্ণা বলল, অসম্ভব। রাজীব কাউকে বিশ্বাস করে না। তোমাকে হঠাৎ নিয়ে গেলে তার রি-অ্যাকসন মারাত্মক হবে। ভাববে তোমাকে দিয়ে তাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেষ্টা করছি।
হঠাৎ নিয়ে যাবে কেন? আগে ওর কনসেন্ট নেবে।
এক্ষুণি তোমাকে কথা দিতে পারছি না। কিছুদিন যাক, লোকটার মতিগতি বুঝতে চেষ্টা করি। যদি দেখি খানিকটা সফট হয়েছে, আমাকে তেমন অবিশ্বাস করছে না, তখন তোমার কথা বলব।