সে যে বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি সেটা বোঝানোর জন্য কঠোর স্বরে সুবর্ণা বলে, কী চান আপনি?
লোকটার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে বলে, আপনি কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমি যা বলব, চুপচাপ শুনে যাবেন।
এই প্রথম লোকটা কথা বলল। তার কণ্ঠস্বর নিচু কিন্তু কর্কশ, একটু ঘষা ঘষা। নির্ভুল বাংলাতেই সে বলেছে, তবে উচ্চারণটা সঠিক নয়। নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ার লোকজনদের কেউ বাংলা ভাষাটা রপ্ত করে বললে যেমন শোনায় অনেকটা সেইরকম।
লোকটার বলার ভঙ্গিতে প্রচণ্ড রকমের কর্তৃত্বের সুর রয়েছে; চাপা একটা হুমকিও। সুবর্ণার মতো সাহসী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েও ভেতরে ভেতরে থমকে গেল। তার কী করা উচিত, ঠিক করে উঠতে পারছিল না। লোকটা এরপর কী বলে বা করে, সে জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এই সময় হরেন বা দেবীর টিউটর, কেউ একজন এসে পড়লে তার মনোবল অনেকটা বাড়ত।
লোকটা এবার বলে, এ বাড়িতে কে কে আছে?’
বাইরে যতই স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করুক, প্রবল উৎকণ্ঠা বোধ করছিল সুবর্ণা। জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, যে-ই থাক, সেটা জানা কি খুবই প্রয়োজন?
অবশ্যই।
আগে বলুন প্রয়োজনটা কিসের?
লোকটার দুচোখে আগুনের হলকার মতো কিছু খেলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ডোন্ট আস্ক মি এনি কোশ্চেন। আমি প্রশ্ন করব, আপনি জবাব দেবেন। একটু থেমে বলে, কারও প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অভ্যস্ত নই। ইজ ইট ক্লিয়ার?
সুবর্ণা চুপ করে থাকে। লোকটা ফের বলে, আমার প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি। বলুন পরক্ষণে কী ভেবে দ্রুত বলে ওঠে, আপনি যদি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেন, আপনাদের এতটুকু ক্ষতি হবে না। নইলে স্পষ্ট একটা ইঙ্গিত দিয়ে সে থেমে যায়।
সুবর্ণা বুঝতে পারে, এখন এই লোকটার হুকুম মতোই তাকে চলতে হবে। ধীরে ধীরে সে জানায়, এ বাড়িতে তার নব্বই বছরের প্রায় অথর্ব দাদাশ্বশুর আছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি একরকম লোপ পেয়ে গেছে। এই মানুষটির কাছে অতীত এবং বর্তমান একাকার। হঠাৎ কখনও পুরনো দিনের কোনও ঘটনা বা মানুষের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিন্তু তা পলকের জন্য। পরক্ষণে সে সব ছবি মুছে যায়। স্মৃতির অদৃশ্য পেটরা খুলে যে দু-একটা টুকরো বেরিয়ে পড়ে, ফের তারা কোথায় উধাও হয় তিনি বুঝতে পারেন না। সুবর্ণার শ্বশুরও এ বাড়িতেই থাকেন। তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি, দু’দুবার স্ট্রোক হয়ে এখন তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। কাজের লোক আছে দু’জন–হরেন আর মায়া। এরা ছাড়া সে নিজে এবং দেবী।
আগে সুবর্ণা ততটা লক্ষ করেনি, এবার তার মনে হল নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি লোকটার চোখে মুখে চাপা একটা টেনসানও ছিল। সব শোনার পর সেটা যেন অনেকখানি কেটে গেছে। তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে জিজ্ঞেস করে, আপনি ঠিক বলছেন?
লোকটা কী বোঝাতে চায়–সে মিথ্যেবাদী? তার স্পর্ধায় মাথায় আগুন ধরে যায় যেন। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনওরকম হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। খুব শান্ত গলায় সুবর্ণা বলে, আপনাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন?
লোকটা বলে, ধরে নিলাম আপনি ঠিকই বলছেন–
তার কথা শেষ হতে না হতেই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে কারও কণ্ঠস্বর, হরেন–হরেন, দরজা বন্ধ কেন? খুলে দাও।
লোকটার চেহারা মুহূর্তে পালটে গেল। কেমন একটা মরিয়া ভাব যেন ফুটে উঠেছে তার মধ্যে। গলা অনেকটা নামিয়ে বলে, লোকটা কে?
সুবর্ণা বলে, দেবীর মাস্টারমশাই। এই সময় পড়াতে আসেন। রোজই দরজা খোলা থাকে। আজ বন্ধ বলে ডাকাডাকি করছেন। লোকটাই যে দরজায় খিল আটকে দিয়েছে সেটা আর বলল না। তবে নিচে নামার জন্য পা বাড়াল।
কিন্তু সুবর্ণার নামা আর হল না। তার আগেই লোকটা গর্জে ওঠে, স্টপ। কোথায় যাচ্ছেন?
সুবর্ণা থেমে যায়। বলে, দরজা খুলে দিতে হবে না? মাস্টারমশাই কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
হিংস্র চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে সিঁড়ি টপকে টপকে সুবর্ণাদের কাছে চলে আসে লোকটা। উগ্র গলায় বলে, কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না।
চালাকি মানে?
দরজা খুলে লোকটাকে ভেতরে এনে আমাকে ঝাটে ফেলতে চাইছেন?
দেবীর টিউটরই যে ডাকাডাকি করছেন, লোকটা তা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেনি। হয়তো সে ভেবেছে টিউটরের নাম করে সুবর্ণা অন্য কাউকে ঢোকাতে চাইছে। তার ফলে সে বিপন্ন হয়ে পড়বে।
সুবর্ণা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা জিনসের পকেট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে একটা পিস্তল বের করে শাসানির ভঙ্গিতে বলে, লুক ম্যাডাম, আমি অ্যাট অল ভায়োলেন্স চাই না। আমি কতদূর যেতে পারি, আপনার ধারণা নেই। লাস্ট টাইম আপনাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার সঙ্গে ডার্টি ট্রিক খেলতে চেষ্টা করবেন না।
দেবী মায়ের একটা হাত চেপে ধরে আছে। সুবর্ণা চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল, পিস্তল দেখে মেয়েটার মুখ ভয়ে, আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। কপালে দানা দানা ঘাম জমেছে। তাকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে লোকটাকে বলে, বিশ্বাস করুন, উনি সত্যিই আমার মেয়ের মাস্টারমশাই। খুবই ভাল মানুষ। নিরীহ এলডারলি পার্সন। ওঁর পক্ষে কারও এতটুকু ক্ষতি করা সম্ভব নয়।
লোকটা কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, অল রাইট, মেনে নিচ্ছি, উনি আপনার মেয়ের প্রাইভেট টিউটর। ওঁকে বলে দিন, আজ পড়াতে হবে না।