হা হা, রাইট–মনোরমা অধিকারী। ওঁর ধারণা ছিল, আজ আপনার ক্লাস দেরিতে। বললেন, যদি সম্ভব হয় আজই সময় করে একবার যেন অর্গানাইজেশনের অফিসে যান। না যেতে পারলে সন্ধের পর উনি আবার বাড়িতে ফোন করবেন।
অনেক ধন্যবাদ।
তরল গলায় এবার রাজীব বলে, আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজটা আশা করি ভালই করেছি, কী বলেন?
উত্তর না দিয়ে সুবর্ণা বলল, আচ্ছা এখন তা হলে ছাড়ি। আপনার যখন যা দরকার, মায়াকে বলবেন। ও দিয়ে যাবে।
সুবর্ণা টেলিফোন নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, ব্যস্তভাবে রাজীব বলে উঠল, ছাড়বেন না, ছাড়বেন না। সব চাইতে ইমপর্টান্ট খবরটাই তো আপনাকে দেওয়া হয়নি।
কী?
কিছুক্ষণ আগে পুলিশের ফোন এসেছিল।
বুকের মধ্যে হিমের স্রোত বয়ে যায় সুবর্ণার। গলার ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো দু’টো শব্দ বেরিয়ে আসে, পুলিশের ফোন!
রাজীব বলল, হ্যাঁ। আপনাকে চাইছিল, বললাম কলেজে গেছেন। আমি কে জানতে চাইল, বলেছি আপনাদের কাজের লোক। আরও বলল, আজ খবরের কাগজে একটা দাড়িওলা ভয়ঙ্কর লোকের খবর বেরিয়েছে। তার মতো কাউকে দেখলে তক্ষুণি যেন থানায় জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে ওরা আপনাকে কন্ট্যাক্ট করবে।
ঠিক আছে। শুকনো, ঝাপসা গলায় বলতে বলতে শিথিল হাতে ফোন নামিয়ে রেখে সুবর্ণা ফের বিমলেশের কাছাকাছি সেই চেয়ারটিতে এসে বসে। এই মুহূর্তে নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছিল না সে। সামনে একটা আয়না থাকলে বুঝতে পারত, তাকে কতটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে।
পুলিশের লোকেরা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর সবাইকে চেনে। কাজের লোক বলে পার পেয়ে গেছে রাজীব। যদি ওরা তার নামটা জানতে চাইত? নিজের নাম অবশ্যই জানাতো না সে। তবে কী বলত? যাই বলুক, পুলিশ সন্দেহের বশে বাড়ি চলে এলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হত কে জানে।
বড় হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে নিল সুবর্ণা। চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ক্লান্তভাবে হাত দিয়ে চেপে চেপে সেগুলো ঠিক করতে লাগল।
সুবর্ণা লক্ষ করেনি, যে স্টাফ রুমে ঢোকার পর থেকে বিমলেশ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ অন্য দিকে সরায়নি। খুব আস্তে করে সে ডাকে, সুবর্ণা–
সুবর্ণা মুখ ফেরায়।
বিমলেশ বলল, তোমাকে আজ ভীষণ রেস্টলেস দেখাচ্ছে।
সুবর্ণা কষ্ট করে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, কই না, আমি ঠিক আছি।
গলার স্বর অনেক নিচে নামিয়ে বিমলেশ জিজ্ঞেস করে, বাড়িতেকাল পুলিশ এসেছিল, আজ ফোন করেছে–
তাকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, পুলিশের ফোনের কথা তোমাকে কে বললে?
তুমি এতক্ষণ টেলিফোনে যা যা বলেছ, আমি সব শুনেছি। পুরোটা বুঝতে পারিনি। কেননা ওধার থেকে যে বলছিল তার কথা আমারপক্ষে শোনা সম্ভব নয়। তবে অনেকটাই বুঝতে পেরেছি।
সুবর্ণা উত্তর দিল না। বিমলেশ স্টাফ রুমের চারপাশ একবার দেখে নিল। আদিনাথ, নবনীতা বা মৃন্ময়ী যাতে শুনতে না পায়, সেইভাবে বলল, তোমার চোখমুখ বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভীষণ টেনসনে আছ।
সুবর্ণা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
বিমলেশ সুবর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, সত্যি কথাটা কি এবার বলবে?
বিহ্বলের মতো সুবর্ণা বলে, কী জানতে চাইছ?
বিমলেশ বলল, আমার ধারণা, টেরোরিস্টটা তোমাদের বাড়িতেই ঢুকে আছে। সে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে ভয়ে, আতঙ্কে তুমি মুখ খুলতে পারছ না। অ্যাম আই রাইট?
সুবর্ণা চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে। এই পৃথিবীতে এখন বিমলেশকেই সবচেয়ে বিশ্বাস করে সে। কিন্তু রাজীব বার বার সতর্ক করে দিয়েছে কোনওভাবেই তার কথা কাউকে বলা চলবে না। নিষ্ঠুর এই হত্যাকারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তার সম্বন্ধে বিমলেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তার পরিণতি সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু কাল সন্ধে থেকে প্রচণ্ড চাপে সুবর্ণার স্নায়ুমণ্ডলী ভেঙে চুরমার হচ্ছে। তার সহ্যশক্তিও শেষ সীমায় পৌঁছেছে। মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা চলছিল, এক সময় মরিয়া হয়েই তা কাটিয়ে ওঠে সুবর্ণা। আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে বলে, তুমি যা বললে সেটাই ঠিক। আমি কী যে করব, বুঝতে পারছি না।
আমাকে সব খুলে বলল। দেখি সমস্যার কোনও সলিউসন বার করা যায় কিনা।
কিন্তু এই স্টাফ রুমে বসে বলাটা রিস্কি হয়ে যাবে। কেউ না কেউ শুনে ফেলতে পারে।
ঠিক। এক কাজ করা যাক—
বল।
তোমার ক’টা পর্যন্ত ক্লাস আছে?
লাস্ট ক্লাসটা তিনটে কুড়িতে শেষ হবে।
আমারও তাই। তারপর আমার ফ্ল্যাটে চল। সেখানে বসে সব শুনব।
একটু ভেবে সুবর্ণা বলে, আজ তোমার ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। দেবীর ছুটির পর ওকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া ফিরতে দেরি হলে লোকটা কিছু সন্দেহ করতে পারে। অবশ্য ও জানে আমি আমাদের উইমেন্স অর্গানাইজেশনের অফিসে কলেজের পর যেতে পারি।
ভালই হল। আমরা দু’জনে লাস্ট ক্লাসটা অফ করে আগে আগে যদি বেরিয়ে পড়ি কোনও প্রবলেম হবে না। আমাকে সবটা বলার পর দেবীকে নিয়ে তুমি ঠিক সময়ে বাড়ি যেতে পারবে।
.
১০.
প্রতাপপুর সিটির মাঝামাঝি মহারাজা সমরেন্দ্রনারায়ণ অ্যাভেনিউতে একটা মাল্টি-স্টোরিড বাড়ির দোতলায় বিমলেশের ফ্ল্যাট। তার সংসার পুরোপুরি ভূততান্ত্রিক। দু’টো কাজের লোক পবন আর হরিলাল সব কিছু চালায়। পবন দুবেলা রান্না করে। হরিলাল বাজার করা, বাসন মাজা, ফাইফরমাশ খাটা–এইসব করে থাকে। দু’জনেই মাঝবয়সী।