নবনীতা আবার বলে, আমার হাজব্যান্ড সকালে বাজারে গিয়েছিল। সে দেখে এসেছে প্রতাপপুর সিটিটা ভীষণ প্যানিকি হয়ে উঠেছে। লোকটার কাছে ডেডলি ওয়েপন রয়েছে। সে নাকি এত ডেসপারেট, যা খুশি করতে পারে।
রাজীব যে কতটা সাঙ্ঘাতিক এবং বেপরোয়া, প্রতাপপুর সিটিতে সুবর্ণার মতো সেটা আর কেউ জানে বলে মনে হয় না। গোটা বাড়িটাকে তার পিস্তলের নলের মুখে রেখে সে আজ কলেজে এসেছে। সেখানে এখন কী হচ্ছে কে জানে।
প্রচণ্ড অস্থিরতা বোধ করছিল সুবর্ণা। গলাটা প্রবল মানসিক চাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বসতে পারছিল না সে। স্টাফ রুমের একধারে একোয়া গার্ড লাগানো আছে। একবার সেখানে গিয়ে জল খেয়ে এল। কিন্তু কণ্ঠনলীর শুষ্ক, খসখসে ভাবটা কিছুতেই কাটছে না।
আদিনাথ বসুমল্লিক, যাঁর কাছে খাওয়াটাই একমাত্র প্যাসন, এছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে যার এতটুকু কৌতূহল নেই, তিনিও যে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন সেটা এবার বোঝা গেল। বললেন, তোমাদের অত বড় প্যালেস, ঢুকে কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা কে জানে। কাগজে লিখেছে পুলিশ কাল রাতে তোমাদের ওখানে গিয়েছিল। ভাল করে চারদিক খুঁজে দেখেছিল তো?
কাঁপা গলায় সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ।
যে মৃন্ময়ী বড়াল বহু বছর তার সঙ্গে কথা বলে না, সেও হঠাৎ বলে উঠল, রাতের অন্ধকারে ওই বিশাল বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করা মুশকিল। পুলিশ ডেকে দিনের আলোয় আগাগোড়া সার্চ করাও। লোকটা কোথাও লুকিয়ে থাকলে তোমরা বিপদে পড়বে।
মৃন্ময়ীকে কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণা। যে মহিলা তাকে। চিরকাল হিংসে করে এসেছে তার এই উদ্বেগটুকু কিন্তু খুবই আন্তরিক যা সুবর্ণার বুকের ভেতর কোনও একটা সূক্ষ্ম, গোপন জায়গায় ঝঙ্কার তুলে গেল। কিন্তু তাকে জানানো গেল না, বিপজ্জনক লোকটা জোর করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর দখল নিয়ে বসে আছে। ফ্যাকাসে একটু হেসে শুধু বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন মৃন্ময়ীদি।
এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি বিমলেশ। চুপচাপ সে শুধু সুবর্ণার অস্থিরতা লক্ষ করছিল। এবার খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে বল তো সুবর্ণা?
সুবর্ণা চমকে ওঠে। বলে, কী আবার হবে? কিছু না বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হয় বাড়ির একটা খবর নেওয়া দরকার। স্টাফ রুমের একধারে একটা টিপয়ের ওপর টেলিফোন রয়েছে। সুবর্ণা সোজা সেখানে গিয়ে ওটা তুলে নিয়ে ডায়াল করল। সে জানে ফোনটা রাজীবই ধরবে। তার সঙ্গে কথা বলে বাড়ির পরিস্থিতিটা নিশ্চয়ই জানা যাবে।
ওধার থেকে রাজীবের গলা ভেসে এল, হ্যালো, কে বলছেন?
কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল নোকটা অতি মাত্রায় সতর্ক হয়ে আছে। ফোন করে কেউ তাকে ফাঁদে ফেলতে চায় কিনা, সেটা যেন বুঝে নিতে চাইছে। সুবর্ণা বলল, আমি–-আমি মিসেস সিংহ।
কোত্থেকে ফোন করছেন?
কলেজ থেকে।
এবার যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল রাজীব। বলল, কোনও দরকার আছে?
সুবর্ণার মতো স্মার্ট, শিক্ষিত মেয়েও বেশ খতিয়ে গেল। একটু ভেবে বলল, আপনার কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
টেলিফোনের ওপ্রান্তে হাসির শব্দ শোনা যায়। হাসতে হাসতে রাজীব বলে, আমার সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্যে আপনি কিন্তু ফোনটা করেননি ম্যাডাম।
বিমূঢ়ের মতো সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, তবে কী জন্যে করেছি?
আপনি জানতে চাইছিলেন, আমি ম্যাসাকার ট্যাসাকারের মতো কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছি কিনা।বলে জোরে জোরে, প্রবল শব্দ করে হেসে ওঠে রাজীব।
লোকটা কি থটরিডার? মুখ না দেখেও, শুধু গলা শুনেই অন্যের মনের কথা জেনে যায়? হতচকিত সুবর্ণা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর যেন ধড়ফড় করতে করতে বলে ওঠে, না না, বিশ্বাস করুন এসব আমি কিছুই ভাবিনি। সে টের পাচ্ছিল এই নভেম্বরেও তার কপালে দানা ঘাম জমে উঠেছে।
রাজীব তার কথার জবাব না দিয়ে বলল, আপনি চলে যাবার পর যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে জানিয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ তো বসে থাকা যায় না। আপনার জড়ভরত দাদামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করেছি। বাট দ্যাটস অ্যাবসোলুটলি ইমপসিবল। উনি অবশ্য দু-একবার রেসপন্ড করতে চাইছিলেন কিন্তু গলা দিয়ে মিহি ঘোড়ার ডাকের মতো সামান্য একটু আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বেরোয়নি। মায়া সকালে ব্রেকফাস্ট দিয়ে সেই যে চলে গিয়েছিল, আর তাকে দেখিনি। খুব সম্ভব এ বাড়িতে আমার প্রেজেন্সটা সে পছন্দ করছে না কিংবা আমাকে ভয় পাচ্ছে। আপনার শ্বশুরমশাই বার দুই হল-ঘরে এসে আমার দিকে তেরছা চোখে তাকাতে তাকাতে ফের নিজের বেডরুমে ঢুকে গেছেন। আমি যে আপনার দাদার পিসতুতো শালা সেটা খুব সম্ভব উনি বিশ্বাস করেননি। আপনার দাদা, বৌদি বা তাদের ছেলেমেয়েদের নাম আমার জেনে নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাই জেরা করলে মুশকিল হত। বাড়ি ফিরে ওঁদের তো বটেই, অন্য ক্লোজ আত্মীয়স্বজনদের নামও জানিয়ে দেবেন। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা তো চাই।
দুর্বোধ্য গলায় কিছু একটা বলতে চাইল সুবর্ণা, পারল না।
রাজীব থামেনি, এর মধ্যে একজন মহিলা ফোন করেছিলেন। খুব সম্ভব আপনি যে উইমেন্স অর্গানাইজেশনটার সঙ্গে যুক্ত উনি তার সেক্রেটারি কিংবা ওইরকম কেউ হবেন। নামটা বলেছিলেন কিন্তু মনে করতে পারছি না। ভেরি সরি।
সুবর্ণা বলল, কে, মনোরমাদি?