সুবর্ণা এক পলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল শুধু।
রোল কলের পর এক মিনিটও সময় নষ্ট করল না সে। অন্যদিনের মতো পড়ানো শুরু করল। ক্লাস লেকচার, নোট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণা। এই ক্লাস-রুম, পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রী এবং জানালার বাইরে প্রতাপপুর সিটির নানা দৃশ্যাবলী আর শব্দপুঞ্জকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে সিনেমার ক্লোজ শটের মতো রাজীবের মুখটা ক্রমশ চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বাড়িতে এখন কী হচ্ছে কে জানে। মায়া যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। নিশ্চয়ই এমন কিছু করবে না যাতে তার নিজের ক্ষতি হয়। কিন্তু হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে যদি হইচই বাধিয়ে বসে? সুবর্ণার মনে হয়েছে, সংগ্রামনারায়ণ রাজীবকে পুরোপুরি বিশ্বাস। করেননি। সন্দেহ মেটাতে যদি তিনি উঠে গিয়ে তার আসল আইডেন্টিটি জানার জন্য চাপ দিতে থাকেন? সুবর্ণা আর ভাবতে পারছিল না।
বছরের পর বছর সিলেবাসে কোনও পরিবর্তন নেই। পড়াতে পড়াতে সব তার মুখস্থ হয়ে গেছে। যান্ত্রিক নিয়মে ক্লাসটা শেষ করে স্টাফ রুমে চলে আসে সুবর্ণা। তার ভেতরে যে প্রচণ্ড আলোড়ন চলছিল, ছেলেমেয়েরা টের পায়নি।
স্টাফরুমের বড় ওয়াল ক্লকটায় বারটা বেজে পাঁচ। এখন পর পর দু’টো পিরিয়ড তার অফ। পরের ক্লাসটা সেই একটা চল্লিশে।
স্টাফ রুমটা মোটামুটি ফাঁকাই। অধ্যাপক অধ্যাপিকারা পরের ক্লাস নিতে চলে গেছেন। যাঁদের অফ-পিরিয়ড তারাই শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে এধারে ওধারে বসে আছেন। ফিজিক্সের নবনীতা পুরকায়স্থ, ভূগোলের বেঢপ মোটা মৃন্ময়ী বড়াল, ইকনমিকসের বিমলেশ ভট্টাচার্য এবং হিস্ট্রির আদিনাথ বসুমল্লিক ছাড়া এখন আর কেউ নেই।
মৃন্ময়ীর যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। দু-তিন বছরের মধ্যে রিটায়ার করবে। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আর করে উঠতে পারেনি। এ জীবনে সেটা আর সম্ভব নয়। সুবর্ণার। প্রতি চিরদিনই তার প্রচণ্ড ঈর্ষা। সুবর্ণা সুন্দরী, অসম্ভব জনপ্রিয় অধ্যাপিকা, ডিভোর্স হয়ে গেলেও সে রাজবংশের বউ–এসব মৃন্ময়ীর মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগে চাঁছাছোলা ভাষায় বিশ্রীভাবে তাকে বিধিয়ে বিধিয়ে কথা বলত। তার আচরণ, অঙ্গভঙ্গি ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগেকার উদ্যম আর ঝঝ অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ভেতরে তার যা-ই থাক, বাইরে একেবারে চুপচাপ। সুবর্ণার সঙ্গে বহুদিন সে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। নবনীতাও এক সময় ছিল প্রচণ্ড ঈর্ষাকাতর। তবে মৃন্ময়ীর মতো অসভ্যতা কখনও করেনি। একটা বর জুটিয়ে ফেলার পর একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুবর্ণার সঙ্গে এখন তার। ব্যবহার যথেষ্ট আন্তরিক। কোনওদিন যে হিংসে করত, বোঝাই যায় না।
আদিনাথ বসুমল্লিকেরও মৃন্ময়ীর মতো রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এসেছে। তিনি একেবারে ঝাড়া হাত-পা মানুষ। কলেজ এবং খাওয়া ছাড়া আর কিছুই। বোঝেন না।
স্টাফ রুমে চতুর্থ যে মানুষটি বসে আছে, সেই বিমলেশের মতো হিতাকাঙ্ক্ষী মা-বাবাকে বাদ দিলে সুবর্ণার জীবনে আর একজনও আসেনি। এমন মালিন্যহীন, স্বচ্ছ মানুষ আগে কখনও দেখেনি সে। ডিভোর্সের পর যখন ভেঙে পড়েছিল, বিমলেশই তাকে আগলে আগলে রেখেছে। তার দীর্ঘ ভবিষ্যতের কথা ভেবে একবারই শুধু বলেছিল, সুবর্ণা রাজি হলে সে তাকে বিয়ে করতে চায়। বুঝিয়েছিল, এই সোসাইটিতে তার এবং দেবীর নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। এমন একজন পাশে থাকা চাই যার ওপর নির্ভর করা চলে, যাকে বিশ্বাস করা যায়।
সুবর্ণা রাজি হয়নি। প্রতাপপুর রাজবংশের প্রতি তার বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। বিক্রম যে শূন্যতার সৃষ্টি করে গ্লিয়েছিল তা ক্রমশ ভরাট হয়ে আসছিল। একটি হৃদয়হীন বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার মনে যা জমা হচ্ছিল তার নাম ঘৃণা। তবু দু’টি অসহায় বৃদ্ধকে ফেলে চলে যেতে পারেনি সে।
বিমলেশ দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা বলেনি। সুবর্ণাকে পায়নি, তবু সর্বক্ষণ অপার সহানুভূতি এবং গভীর মমতায় সে তাকে ঘিরে আছে। কাম্য নারীটি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, সে জন্য তার মনে হয়তো দুঃখ আছে, আছে আক্ষেপ এবং তীব্র, গোপন কাতরতা। বাইরে কিন্তু তার প্রকাশ নেই। সুবর্ণাকে ছাড়া অন্য মেয়ের কথা সে ভাবতেই পারে না। একটা জীবন কাছাকাছি থেকেও তারা দূরেই রয়ে গেল।
অ্যাটেন্ডান্স রেজিস্টারটা টেবলের এক ধারে রেখে বিমলেশের কাছে এসে বসে পড়ল সুবর্ণা।
আদিনাথের নিত্যকর্মপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে কলেজে এসে দু’বার টিফিন খাওয়া। দশটায় ভরপেট ভাত খেয়ে দু’টো টিফিন বাক্স বোঝাই করে খাবার নিয়ে আসেন। বারটায় এবং চারটেয় তাঁর টিফিনের সময়। নিয়মানুযায়ী প্রথম বাক্সটা খুলে খেতে শুরু করেছিলেন। সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার বল তো? কাগজে দেখলাম একটা মারাত্মক টেরোরিস্ট তোমাদের ওদিকে নাকি কাল ঘোরাঘুরি করছিল। পুলিশ চেজ করাতে ভ্যানিশ হয়ে যায়। তোমাদের প্যালেসে ঢুকে পড়েনি তো?
নবনীতা বিশাল টেবলের শেষ প্রান্ত থেকে বলে উঠল, রিপোর্টটা আমিও দেখেছি। লোকটার যে ছবি ছাপা হয়েছে, মনে হয় রুথলেস মার্ডারার। তোমাদের জন্যে এত ভয় করছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন করব।’
না না, আমাদের বাড়িতে টেরোরিস্টটা ঢোকেনি। এমন ত্রস্তভাবে সুবর্ণা কথাগুলো বলল যে তার নিজের কানেই কেমন যেন বেখাপ্পা ঠেকল।