সংগ্রামনারায়ণ জিজ্ঞেস করেন, ও-ই যে তোমার বৌদির পিসতুতো দাদা, বুঝলে কী করে?
প্রায় মরিয়া হয়ে সুবর্ণা বলে, আমার দাদার চিঠি নিয়ে উনি এসেছেন।
আর কোনও প্রশ্ন করলেন না সংগ্রামনারায়ণ। শুধু বললেন, আচ্ছা যাও।
সংগ্রামনারায়ণের সন্দেহ সম্পূর্ণ কেটেছে কি না বোঝা গেল না। সুবর্ণা আর দাঁড়াল না, সোজা নিজের ঘরে চলে এল।
মায়া তার জন্য অনেকক্ষণ আগে চা এবং দু স্লাইস টোস্ট রেখে গিয়েছিল। কাপটা তুলে ঠোঁটে ঠেকাতেই দেখা গেল চা জুড়িয়ে একেবারে জল। মাখন লাগানো টোস্ট ঠান্ডা হয়ে জুতোর চামড়ার মতো শক্ত হয়ে গেছে। মায়াকে বললে পাঁচ মিনিটের ভেতর আবার করে এনে দেবে।
সুবর্ণার চোখ দ্রুত হল-ঘরে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটার দিকে চলে গেল। ন’টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। সে ঠিক করে ফেলল, এখন আর কিছু খাবে না।
একবারে ভাত খেয়ে সওয়া দশটায় দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে।
দেবীর ক্লাস এগারোটায় শুরু। বাড়ি থেকে মোটরে মিনিট পাঁচেকের পথ। দশটা পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশে বেরুলেও অসুবিধা নেই। অন্যদিন হরেনই তাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়, ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু রাজীব ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢোকার পর দেবী এত ভয় পেয়ে গেছে যে মাকে ছাড়তে চাইছে না। তাই সুবর্ণা ওকে স্কুলে পৌঁছে তো দেবেই, ছুটির পর সঙ্গে করে নিয়েও আসবে।
দেবীকে খানিকক্ষণ পড়িয়ে সুবর্ণা তাকে বাথরুমে পাঠাল। তারপর নিজেও স্নান করে নিল। সোয়া দশটায় খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ি থেকে বেরুবার আগে মায়াকে বলল, বাবাকে ঠিক বারটায় খেতে দিয়ে দাদাভাইকে নিজে খাইয়ে দেবে। আমি বিকেলে এসে বাবাকে ওষুধ খাওয়াব।’ কলেজে বেরুবার আগে রোজ এই কথাগুলো মায়াকে মনে করিয়ে দেয় সে, যদিও এর কোনও প্রয়োজন নেই। কেননা মায়ার দায়িত্ববোধ যথেষ্ট। সে থাকতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণের এতটুকু অযত্ন হবে না।
মায়া চাপা, ভীরু গলায় জিজ্ঞেস করল, আর ওই লোকটা?’
সুবর্ণা বলল, উনি যখন আমাদের বাড়িতে এসেছেন তখন অতিথিই। না খাইয়ে তো রাখা যাবে না। উনি কখন খান জানি না, জিজ্ঞেস করে এসে বলছি।
রাজীব সংগ্রামনারায়ণের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বেডরুমে চলে গিয়েছিল। একটা চেয়ারে এখন চুপচাপ বসে আছে। সুবর্ণা তার কাছ থেকে জেনে এসে মায়াকে বলল, বাবা আর দাদাভাইয়ের খাওয়া হলে ওঁকে খেতে দেবে। ঘরে দিতে হবে না, খাওয়ার টেবলে দিও।
মায়া এবার কী বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তার মনোভাব বুঝতে পারছিল সুবর্ণা; ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, কোনও ভয় নেই। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে চলবে। তা হলে ওই ভদ্রলোক কোনও ঝামেলা করবেন না। আরেকটা কথা–’
মায়া জিজ্ঞেস করে, কী?
ওর কাছে যে পিস্তল-টিস্তল আছে, বাবাকে বলবে না।
আচ্ছা–
.
০৯.
সুবর্ণা বাড়ির গাড়ি কখনও ব্যবহার করে না। প্রতাপপুর সিটিতে প্রচুর সাইকেল রিকশা আর অটো। সামনে যেটা পাওয়া যায় সেটা ধরেই সে কলেজে যাতায়াত করে। অন্য কোনও দরকারে বেরুলেও সেই অটো কিংবা রিকশা।
প্যালেস থেকে বেরিয়ে একটা সাইকেল রিকশা নিল সুবর্ণা আর দেবী। কাল ওসি রামেশ্বর বসাক বলেছিলেন, তাদের বাড়ির চারপাশে নজরদারি করার জন্য প্লেন ড্রেসের পুলিশ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন রাস্তায় প্রচুর লোকজন। সর্বত্র ব্যস্ততা। দোকানপাট, পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, যেদিকেই তাকানো যাক, উপচে পড়া ভিড়। তীক্ষ্ণ চোখে এধারে ওধারে লক্ষ করতে লাগল সুবর্ণা কিন্তু বিশাল জনতার মধ্যে কারা সাদা পোশাকের পুলিশ, জানা অসম্ভব। ভিড়ের ভেতর তারা নিশ্চয়ই মিশে আছে। কীভাবে এই অদৃশ্য পুলিশ বাহিনী রাজীবের জন্য গোপন ফাঁদ পেতে রেখেছে কে জানে।
দেবীদের রানী রাজেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল’টা আগে পড়ে। তাকে গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা যখন তার কলেজে পৌঁছল, ঘড়িতে এগারোটা বেজে নয়। আজ তার প্রথম ক্লাস এগারটা দশে। হাতে একটুও সময় নেই।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সোজা স্টাফ রুমে এসে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাটেন্ডান্স রেজিস্টারটা নিয়ে উধ্বশ্বাসে উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় ক্লাস রুমে চলে এল সুবর্ণা। চোদ্দ পনেরো বছর এই কলেজে পড়াচ্ছে সে, একদিনও এক মিনিট দেরিতে সে ক্লাসে ঢোকেনি। আজ কিন্তু প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করেও ঠিক সময়ে পৌঁছুনো গেল না।
রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’ এক সময় ছিল শুধু মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। পরে কো-এড করা হয়। ক্লাসের মাঝখান দিয়ে সরু প্যাসেজ। সেটার একধারে মেয়েদের বসার জন্য সারি সারি বেঞ্চ, আরেক দিকের বেঞ্চগুলো ছেলেদের। মাঝখানের প্যাসেজটাকে ডিমার্কেশন লাইন বা সীমান্তরেখা বলা যেতে পারে।
সুবর্ণার পড়ানোর স্টাইল, ব্যক্তিত্ব আর চমৎকার ব্যবহার–সব মিলিয়ে এমন দারুণ একটা আকর্ষণ রয়েছে যে, পারতপক্ষে ছেলেমেয়েরা তার ক্লাস কামাই করে না। তাছাড়া সে যেসব নোট দেয় সেগুলো পরীক্ষার পক্ষে খুবই জরুরি। ক্লাসে অ্যাবসেন্ট থাকা মানে নোটগুলো পাওয়া যাবে না, তাতে তাদেরই ক্ষতি।
সুবর্ণা ক্লাসে ঢুকে ঝড়ের গতিতে রোল কল করে রেজিস্টারটা টেবলের একধারে রেখে দিল। মেয়েদের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠল, দিদি আজ আপনি ছ’মিনিট লেটে ক্লাসে এসেছেন।