মায়া খাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সুবর্ণা বলল, এত বেলা হয়ে গেছে। আগে ডাকো নি কেন?
মায়া বলে, তিন-চার বার ডেকে গেছি। ভাবলাম কাল ওইরকম একটা ধকল গেছে। নিশ্চয়ই ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই আর জোর করে জাগাই। নি।
মায়া ধকলের কথা বলতে রাজীবের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বুকর ভেতর ভয়ের ছায়া পড়ে। যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, একরকম কেটে গেছে। এই সকাল থেকে আবার দীর্ঘ, একটানা উৎকণ্ঠার শুরু। কিন্তু কিছুই করার নেই সুবর্ণার; অদ্ভুত এক মরণফাঁদে তারা আটকে গেছে। স্নায়ুমণ্ডলী কতকাল এই চাপ সহ্য করতে পারবে কে জানে।
বিছানা থেকে নামতে নামতে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, দেবীকে খেতে দিয়েছ?
হ্যাঁ দেবী মা’র খাওয়া হয়ে গেছে।
বাবা?
উনি শুধু চা আর দু’খানা বিস্কুট খেয়েছেন। আপনাকে খুঁজছিলেন।
মুখ টুখ ধুয়ে যাচ্ছি। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সুবর্ণা বলল, দাদুরও তো কিছু খাওয়া হয়নি।
মায়া বলে, কী করে হবে? আপনি জোর করে না খাওয়ালে তো খেতেই চান না।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল, কাল যিনি আমাদের বাড়ি এসেছেন, তাকে চা দিয়েছ?
ত্রস্ত স্বরে মায়া বলে, না।
বাথরুমের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সুবর্ণা। বলে, কেন?
লোকটার কাছে যেতে আমার হাত-পা কাঁপে। তাই—
ঠিক আছে, তুমি সবার খাবার গুছিয়ে রাখো। আমি আসছি।
মায়া চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর মুখ ধুয়ে বাসি কাপড় বদলে কিচেনে চলে এল সুবর্ণা। একটা মস্ত ট্রেতে তিনজনের মতো ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল মায়া। সংগ্রামনারায়ণের ফ্যাটওলা খাবার খাওয়া বারণ। তার জন্য রয়েছে নরম করে সেঁকা দু-স্লাইস পাঁউরুটি, কলা, ছানা আর এক গ্লাস ঠুট জুস। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের দুই মাড়িতে একটাও দাঁত নেই, তিনি চিবোতে পারেন না। তাই তার জন্য ছানা, ফলের রস আর পাতলা সুজি। তবে রাজীবের জন্য কড়া বাটার টোস্ট, কলা, ওমলেট এবং চা।
ট্রেটা হাতে তুলে নিয়েছিল মায়া। সুবর্ণা তার হাত থেকে সেটা নিয়ে বলল, তোমাকে যেতে হবে না। আটটা বেজে গেছে। রান্না চড়িয়ে দাও।
মায়া বলল, হরেনদা নিচ থেকে জিজ্ঞেস করছিল বাজারে যেতে হবে কিনা।
ফ্রিজে মাছ-মাংস আনাজ যা আছে, আজ চলে যাবে না?
যাবে।
তাহলে বাজারে যাওয়ার দরকার নেই।
হরেনদা ফের ডাকলে তাই বলে দেব।
কী রান্না হবে তা আর জানতে চাইল না মায়া। অনেক বছর সে এখানে আছে। চারবেলা কে কী খাবে, সব তার মুখস্থ।
মিনিট পনেরো পর আমার চাটা আমার ঘরে দিয়ে যেও। বলে সোজা সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে চলে এল সুবর্ণা। বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে প্রতাপপুরের লোকাল বাংলা কাগজ দৈনিক দিনকাল’ পড়ছিলেন তিনি। বিকেলে এ বাড়িতে আসে কলকাতার একটা ইংলিশ ডেইলি। স্বাধীনতার পর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা ছোট এয়ারপোর্ট করা হয়েছে। ট্রেন আর দূর পাল্লার বাস ছাড়াও প্লেনে কলকাতার সঙ্গে এখন প্রতাপপুরের নিবিড় যোগাযোগ। দুপুরের ফ্লাইটে প্যাসেঞ্জার এবং নানা মালপত্রের সঙ্গে কলকাতার যেসব কাগজ আসে, বিকেলে সেগুলো বাড়ি বাড়ি বিলি হয়। সকালবেলা দৈনিক দিনকাল’ ছাড়া আর কোনও কাগজ নেই। স্থানীয় পত্রিকা বলে এখানকার মানুষজনের আলাদা একটা আবেগ রয়েছে। কলকাতার কাগজগুলোর মতো ছাপাটাপা বা লেখা অত ভাল না হলেও, চোখ ধাঁধানো রঙিন ছবি না থাকলেও সবাই ভাবে এটা তাদের একান্ত নিজস্ব পত্রিকা। তাই প্রতাপপুর সিটিতে দৈনিক দিনকাল’-এর প্রচুর কাটতি। প্রায় সব বাড়িতেই কাগজটা রাখা হয়।
পায়ের আওয়াজ শুনেও কাগজ থেকে চোখ সরালেন না সংগ্রামনারায়ণ। বললেন, মায়া বলছিল আজ সকালে ঘুম ভাঙতে তোমার বেশ দেরি হয়েছে। শরীর কি খুব খারাপ হয়েছিল?
সুবর্ণা ট্রে থেকে খাবারের প্লেট আর ফুট জুসের গ্লাস খাটের পাশের একটা নিচু সাইড টেবলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, না।
হাতের কাগজটা একপাশে রেখে এবার সুবর্ণার দিকে তাকালেন সংগ্রামনারায়ণ। বললেন, তোমাকে দেখে কিন্তু ভাল লাগছে না। চোখ-টোখ বসে গেছে।
অন্যদিন মুখ ধুয়ে ড্রেসিং টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনি দিয়ে চুল ঠিক করে নেয় সুবর্ণা। আজ বাথরুম থেকে বেরিয়েই কিচেনে চলে গিয়েছিল। আয়নায় নিজেকে দেখা হয়নি। না দেখলেও সংগ্রামনারায়ণ যখন বলছেন, নিশ্চয়ই তার চোখেমুখে কিছু একটা ছাপ পড়েছে। রাজীব এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে যে ভয় আর উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছিল এটা তারই চিহ্ন।
খাবারের প্লেট নামানো হয়ে গিয়েছিল। সংগ্রামনারায়ণের খাটের আরেক ধারে উঁচু একটা টেবলে নানা আকারের সারি সারি ওষুধের শিশি আর প্যাকেট সাজানো রয়েছে। সেগুলো থেকে গোল, চৌকো, লম্বা, লাল, সবুজ, হলুদ-সব মিলিয়ে পাঁচটা ক্যাপসিউল আর ট্যাবলেট বের করে খাবারের প্লেটগুলোর পাশে রাখতে রাখতে সুবর্ণা বলল, না না, আমি ঠিক আছি।
বিয়ের পর সে যখন নিচে থাকত, সংগ্রামনারায়ণ তার সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। কখনও সখনও একতলায় নামলে তার দিকে তাকাতেন না পর্যন্ত। তিনি নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর দেবীকে নিয়ে সুবর্ণা দোতলায় উঠে এল। তখন অবশ্য কথা বলতেন, কিন্তু খুবই কম। যেটুকু না হলে নয়, ঠিক ততটুকুই। তবে দেবীর ব্যাপারটা বরাবরই আলাদা। সুবর্ণারা নিচে থাকার সময়ও রোজই মায়াকে পাঠিয়ে তাকে ওপরে নিয়ে যেতেন সংগ্রামনারায়ণ। রুক্ষ, কর্কশ, উগ্র একটি মানুষের ভেতর থেকে স্নেহপ্রবণ, কোমল আরেকটি মানুষ বেরিয়ে আসত। আসলে প্রতিটি মানুষের মধ্যে কত ধরনের মানুষ যে লুকানো থাকে! নানা সময়ে নানা চেহারায় বিদ্যুৎচমকের মতো তারা বেরিয়ে পড়ে।