শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণের সেবাযত্ন, দেখাশোনা, দেবীর পড়া, কলেজ, পরীক্ষার পেপার দেখা–এসবের পরও আচমকাই মেয়েদের একটা অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সুবর্ণা। প্রথম প্রথম এত দিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে যেত। এখন আর অসুবিধা হয় না। তার দৈনন্দিন যা রুটিন তাতে একটা দিন আরেকটা দিনের হুবহু জেরক্স কপি। সমস্ত কিছুই গতানুগতিক, খানিকটা বা যান্ত্রিক। কখনও কখনও সুবর্ণার মনে হয়, ভাবাবেগের চেয়ে দায়িত্বপালনই তার কাছে ক্রমশ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
এইভাবেই চলছিল। দেবীকে বড় করে তোলা ছাড়া ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট আর কোনও বড় লক্ষ্য সুবর্ণার সামনে আপাতত নেই।
এর মধ্যেই আজ সশস্ত্র, সাঙ্ঘাতিক এক হত্যাকারী যার বিরুদ্ধে গণ্ডা গণ্ডা খুনের চার্জ, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢুকে সমস্ত পরিবেশটা অসীম ত্রাস এবং উৎকণ্ঠায় ভরে দিয়েছে। …
অন্ধকারে উঁচু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। বাইরে হল-ঘরে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা সুরেলা ঝংকার তুলে জানিয়ে দিল বারোটা বাজে।
অন্যদিন এর মধ্যে দু-তিনবার শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে দেখে আসে সুবর্ণা। আজ সমস্ত অতীতটা অজস্র পুরনো ঘটনার মধ্যে তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে ওঁর কথা খেয়াল ছিল না। যদিও রাজীব ভেতর থেকে দরজায় খিল তুলে ছিটকিনি আটকে দিয়েছে তবু শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খবর নেওয়া দরকার। দেবী তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। খুব সন্তর্পণে সুবর্ণা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মশারি তুলে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এ ঘরের দরজা বন্ধ আছে ঠিকই, তবে হল-ঘরের দিকের জানালার একটা পাল্লা খানিকটা ভোলা। ভেতরে নীলাভ নাইট ল্যাম্প জ্বলছে।
জানালার ফাঁকে চোখ রেখে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে আবছা আলোয় দেখতে চেষ্টা করল সুবর্ণা। লেপ মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি। কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে নিজের বেডরুমের দিকে যাবে, অন্ধকারে পায়ে কী একটা লেগে সামান্য শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে রাজীবের তীক্ষ্ণ চাপা গলা ভেসে এল, কে? পরক্ষণে হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে জানালার ওধারে এসে দাঁড়াল সে। তার হাতে সেই পিস্তলটা সুবর্ণার দিকে তাক করা।
ঘুমের মধ্যেও লোকটার স্নায়ু কতখানি সজাগ, মুহূর্তে টের পেয়ে যায় সুবর্ণা। সংগ্রামনারায়ণের ইন্দ্রিয়ও খুব সতর্ক কিন্তু এতটা নয়। আগেও তার মনে হয়েছে, এখন আরও একবার টের পেল আক্রমণের আশঙ্কা রাজীবকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। তাই ঘুমন্ত বা জাগ্রত, যে কোনও অবস্থাতেই তার স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে থাকে।
কাঁপা গলায় সুবর্ণা সাড়া দেয়, আমি–’
ধীরে ধীরে পিস্তলসুদ্ধ হাতটা নামিয়ে নেয় রাজীব। বলে, ও, আপনি। আমি ভেবেছিলাম অন্য কেউ।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব থামেনি। সে বলে, আরেকটু হলে কী বিশ্রী একটা ব্যাপার হয়ে যেত বলুন তো। অন্ধকারে আপনাকে চিনতে পারিনি। ট্রিগারে চাপ পড়লে আচমকা একটা বুলেট বেরিয়ে যেতে পারত। এভাবে না জানিয়ে রাত্রিবেলা চলে আসবেন না। মনে থাকবে?
সুবর্ণা আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয়, বলে, থাকবে। তার কণ্ঠস্বরের কাঁপুনি একই রকম রয়েছে।
রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনি বোধহয় আপনার গ্র্যান্ড ফাদার-ইন-ল’কে দেখতে এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনাকে তো বলেছি, আমি যতদিন আছি, গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যানটি রাত্তিরে ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
ঠিক আছে।
শুতে চলে যান। অনেক রাত হয়ে গেছে।
সুবর্ণা তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, রাজীব ডাকে, শুনুন—
সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
রাজীব কর্কশ সুরে বলে, যে কোনও জন্তুর চেয়ে আমার নার্ভগুলো বেশি অ্যালার্ট। যদি ঘুমিয়েও পড়ি কোনওরকম সুযোগ নেবার চেষ্টা করবেন না। সেটা আপনাদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
লোকটার ইঙ্গিত মোটামুটি স্পষ্ট। ঘুমন্ত অবস্থায় সুবর্ণা তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে, সেটাই হয়তো বোঝাতে চাইছে। ত্রস্ত ভঙ্গিতে সে বলে, বিশ্বাস করুন, বুড়ো মানুষটাকেই দেখতে এসেছিলাম। কয়েক বছর ধরে রাতে তিন চার বার ওঁকে দেখে যাচ্ছি। এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।
অন্ধকারে অনেকক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর নরম গলায় বলে, বিশ্বাস করলাম।
সুবর্ণা আর দাঁড়ায় না, নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে।
» ০৮. ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা
০৮.
ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা সুবর্ণার চিরকালের অভ্যাস। সূর্যোদয় হয়ে গেছে, অথচ সে বিছানায় শুয়ে আছে, খুব অসুস্থ হয়ে পড়া ছাড়া এমনটা কখনও ঘটেনি।
আজকের দিনটা কিন্তু ব্যতিক্রম।
মায়ার ডাকে ধড়মড় করে উঠে সুবর্ণা দেখল, বেশ বেলা হয়েছে। পুব দিকের দুই জোড়া জানালা দিয়ে নভেম্বরের ঠান্ডা সোনালি রোদের ঢল নেমেছে ঘরের ভেতর। সকালের দিকে অন্যদিন অনেকটা সময় কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে থাকে। আজ কিন্তু প্রতাপপুর সিটির বাড়িঘর, রাস্তা, গাছপালা–সব কিছু স্পষ্ট। কোথাও কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই।
দেবী তার আগেই উঠে পড়তে বসে গেছে। ওকে কোনওদিনই পড়ার জন্য তাড়া দিতে হয় না।