সুবর্ণা উত্তর দেয়নি, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল, সংগ্রামনারায়ণ কারও কাছে ঋণী থাকতে চান না। সেটা তার রাজকীয় দম্ভে বাধবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর সুবর্ণা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেছে, আমি কি এখন যাব?’
সংগ্রামনারায়ণ বলেছেন, হ্যাঁ, যাও।সুবর্ণা যখন দরজার কাছাকাছি গেছে সেই সময় পেছন থেকে হঠাৎ ডেকেছিলেন, শোন–
সুবর্ণা ঘুরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়েছিল।
সংগ্রামনারায়ণ বলেছেন, আজ থেকে দেবী আর তুমি আমার পাশের ঘরে থাকবে। হরেনকে পাঠিয়ে দাও। ওকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
সুবর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামতে নামতে অবাক যে হয়নি তা নয়। পরে ভেবে দেখেছে, মুখ ফুটে না বললেও বিয়ের চার বছর পর তাকে দোতলায় গিয়ে থাকতে বলাটা তার কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। কিংবা এমনও হতে পারে হার্ট-অ্যাটাকটা সংগ্রামনারায়ণের মনোবল অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছিল। পাশে তখন এমন একজনকে দরকার যার ওপর নির্ভর করা চলে। হয়তো ভেবেছিলেন, যে সুবর্ণা। তার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার হাতে নিজের দায়িত্ব তুলে দেওয়া যায়।
সেদিনই দেবীকে নিয়ে দোতলায় চলে গিয়েছিল সুবর্ণা। কৃতজ্ঞতা, নির্ভরতা, বিশ্বাসের সঙ্গে পুরনো রাগ এবং বিদ্বেষ আর রাজকীয় দম্ভ-সব মিলিয়ে তার সম্পর্কে সংগ্রামনারায়ণের মনোভাবটা ছিল অদ্ভুত রকমের জটিল। ক্রমশ ধীরে ধীরে এটা মেনে নিয়েছিল সুবর্ণা। বিক্রম নেই, কিন্তু রয়েছেন অসহায় দুটি মানুষ। একজন স্মৃতিভ্রষ্ট শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ, অন্যজন রুণ, প্রায়-পঙ্গু সংগ্রামনারায়ণ। অদৃশ্য এক শৃঙ্খল যেন এবং বাড়ির সঙ্গে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। এ এক আশ্চর্য বন্ধন।
সুবর্ণা নিজে থেকে কোনওদিন কৌতূহল প্রকাশ করেনি। তবে মেজাজ ভাল থাকলে মাঝে মাঝে টুকরো টুকরোভাবে সংগ্রামনারায়ণ প্রতাপপুর স্টেটের কিছু কিছু খবর তাকে শুনিয়েছেন। দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে যখন একাকার হয়ে গেল তখন ক্ষতিপূরণ হিসেবে পুরনো রাজা-মহারাজা এবং নবাবদের পরিবারগুলিকে বার্ষিক বিরাট অঙ্কের রাজন্যভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা হল। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তখন সুস্থ ছিলেন, বোধবুদ্ধি সম্পূর্ণ অটুট। তার কাছে এটা অত্যন্ত অপমানজনক মনে হয়েছিল। প্রায় স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সামান্য বকশিস তিনি মেনে নিতে পারেননি। এ যেন গরু মেরে জুতো দানের মতো ঘটনা। নেহরু এবং প্যাটেলকে এ জন্য সর্বাংশে দায়ী করেছিলেন তিনি। তাঁদের নাম শুনলে খেপে যেতেন। ফলে প্রতাপপুর স্টেট বার্ষিক ভাতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।
বাবার মতো সংগ্রামনারায়ণের কাছেও রাজত্বের মর্যাদা ছিল সবার চেয়ে মূল্যবান। নেহরু প্যাটেলের প্রতি বিদ্বেষটা উত্তরাধিকার সূত্রে তিনিও। পেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির একজন সামান্য ভোটার হয়ে বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মতো ঘটনা। জীবনে তিনি কখনও ভোট দেননি এবং ভারত সরকারের গ্রান্টও স্পর্শ করেননি।
পূর্বপুরুষদের মতো উড়নচণ্ডে নন সংগ্রামনারায়ণ। ঠাকুরদা, তার বাবা কিংবা তার বাবাদের মতো দশ হাতে খোলামকুচির মতো টাকা ওড়াননি। পারিবারিক যা সঞ্চয় ছিল, তা থেকে বিক্রম কয়েক লাখ সরিয়ে নিয়ে গেলেও যেটুকু অবশিষ্ট আছে, আগেকার মতো রাজকীয় মেজাজে না হলেও বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবু আর্থিক ব্যাপারে তার হয়তো চাপা দুশ্চিন্তা ছিল। তাই খরচ কাটছাঁট করতে শুরু করেছিলেন। তখনও সব মিলিয়ে দশ বারোজন কাজের লোক ছিল। হরেন আর মায়াকে রেখে বাকিরা ভবিষ্যতে যাতে কষ্টে না পড়ে, তাই মোটা টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। গাড়ি ছিল তিনটে। পুরনো, দামী স্টুডিবেকার আর ফোর্ডটা বেচে দিয়েছিলেন।
এর মধ্যে আরও একটা ঘটনা সুবর্ণাকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়ে গেছে। সেই যে বিক্রম রুবিকে নিয়ে উধাও হয়েছিল, অনেকদিন তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে উড়ো খবর ভেসে আসত, সে নাকি লখনৌতে আছে। কখনও বা শোনা যেত, লখনৌ নয়–কলকাতায়। হঠাৎ একদিন বিক্রমের তরফ থেকে ল-ইয়ারের একটা নোটিশ এসেছিল। সে ডিভোর্স চায়। কারণ দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাব, ইত্যাদি। নোটিশ থেকে বিক্রমের ঠিকানাও পাওয়া গিয়েছিল। সে তখন দিল্লিতে থাকত।
দু’টো দিন দারুণ অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে সুবর্ণার। তারপর মনস্থির করে উকিলের চিঠিটা সংগ্রামনারায়ণকে দেখতে দিয়েছিল। হার্ট-অ্যাটাকের পর ডাক্তারের নির্দেশে চুপচাপ, শান্তই থাকতেন তিনি, কিন্তু সেদিন আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, হারামজাদা চোরটাকে ডিভোর্স দিও না বৌমা। সেই প্রথম সুবর্ণাকে তার বৌমা বলা। হয়তো এইভাবেই তিনি তাকে প্রতাপপুর রয়্যাল ফ্যামিলিতে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
কয়েক বছর আগে হলে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যেত। কিন্তু এখন তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই হয়নি। উদাসীনভাবে সংগ্রামনারায়ণের কথাগুলো শুনে গেছে সে, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েনি। বিক্রমের ল-ইয়ারকে জানিয়ে দিয়েছিল, বিবাহ বিচ্ছেদে সে রাজি।
ছ’মাস পর বম্বে থেকে কোর্টের রায় এসে গিয়েছিল। সম্পূর্ণ আইনসঙ্গতভাবে ডিভোর্সটা হয়ে গেছে। বহুকাল যোগাযোগ নেই বিক্রমের সঙ্গে, তবু মানসিক দিক থেকে যে সূক্ষ্ম, পলকা সম্পর্কটা তখনও অস্পষ্টভাবে থেকে গিয়েছিল সেটুকুও চিরকালের মতো ছিন্ন হয়ে গেল। বুকের মধ্যে কোথাও কি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল? আসলে অভাববোধটা মানুষের নিজেরই তৈরি। সুবর্ণার ক্ষেত্রে তেমন কিছু একটা হয়ে থাকবে। কিন্তু ভ্যাকুয়াম চিরকাল বুঝিবা থাকে না, ধীরে ধীরে তা পূর্ণ হয়ে যায়।