শহর দূরে থাকায় বাইরের শব্দ ট রাজবাড়িতে তেমন একটা ঢোকে না। তবে এই মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কোথায় যেন পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ, মানুষজনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, অনেকের ছোটাছুটির শব্দ অস্পষ্টভাবে সুবর্ণার কানে ভেসে এল। ইদানীং কয়েক বছর প্রতাপপুর সিটি নানা ধরনের ক্রিমিনালদের প্রায় অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। পুলিশ অ্যান্টি-সোশালদের দু-একটা দলকে মাঝে মধ্যে তাড়া করে কর্তব্য পালন করে এবং এভাবেই চাকরি বজায় রাখে। নেহাত রুটিন ব্যাপার। সুবর্ণা বিন্দুমাত্র কৌতূহল বোধ করল না। মেয়েকে নিয়ে যেমন নামছিল তেমনই নামতে লাগল। সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় ল্যান্ডিংয়ের কাছাকাছি যখন ওরা চলে এসেছে সেই সময় হল-ঘরের দরজার দ্বিতীয় পাল্লাটা ঝড়াং করে খুলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকে বিদ্যুৎগতিতে ছিটকিনি আটকে খিল তুলে দিল। তারপর দরজার গায়ে ঠেসান দিয়ে জোরে জোরে হাঁফাতে লাগল। মনে হল, বহুদূর থেকে কারও তাড়া খেয়ে ছুটে আসছে সে।
সুবর্ণা আর দেবী থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। রাজবাড়ির প্রায় একশ বছরের ইতিহাসে কেউ কখনও এভাবে ঢুকে পড়েছে কিনা সুবর্ণার জানা নেই। দেবী ভীষণ ভয় পেয়েছিল। মায়ের একটা হাত খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রইল সে।
সুবর্ণাও এমন একটা অভাবনীয় ঘটনায় একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিল। তবে সে খুবই সাহসী। দু-এক পলকেই নিজেকে সামলে নেয়। তারপর মেয়ের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ভয়ের কিছু নেই। লোকটার দিকে চোখ রেখে চাপা গলায় বলে, কথা বলিস না, চুপ করে থাক।
দরজার মাথায় টিউব লাইটটা দিন পনের আগে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকবার হরেনকে ওটা পালটানোর কথা বলেছে সুবর্ণা। কিন্তু কথাটা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। টিউবটা পালটানো হয়নি। হরেন রাজবাড়ির দারোয়ান এবং বাজার সরকার। তাছাড়া টুকিটাকি নানা কাজ তার করার কথা। কিন্তু সে প্রচণ্ড রকমের ফাঁকিবাজ। এই যে অচেনা লোকটা আচমকা হল-ঘরে ঢুকে পড়েছে, সেটা আদৌ সম্ভব হত না যদি এই সময়টা সে গেটের কাছে থাকত। নিশ্চয়ই কোথাও আড্ডা টাড্ডা দিতে গেছে।
হল-ঘরে অন্য যে টিউবগুলো জ্বলছিল তার আলোয় লোকটাকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তার চোখে মুখে খানিকটা মঙ্গোলিয়ান ছাপ। ভাঙা গালে দাড়ির জঙ্গল। চোখের তলায় সিকি ইঞ্চি পুরু কালি। উসকো-খুসকো, রুক্ষ চুলে বহুদিন কাঁচি পড়েনি। পরনে রং-ওঠা ফ্যাকাসে জিনস, যেটার ডান পায়ের নিচের অনেকটা অংশ ছেঁড়া। এছাড়া হাফশার্টের ওপর রোঁয়াওলা মোটা উলের ময়লা সোয়েটার। পায়ে যে ফিতেওলা পুরনো স্পোর্টস শুটা রয়েছে তার রং একসময় ধবধবে সাদাই ছিল, এখন কালচে। সোলও অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। কপাল, গাল, কনুই থেকে হাতের নিচের দিকটা–অর্থাৎ শরীরের যেসব অংশ খোলা, সেগুলোর চামড়া কর্কশ এবং তামাটে। মনে হয় একদিন লোকটার গাত্রবর্ণ হলদেটে ছিল। রোদে পুড়ে। জলে ভিজে, প্রচণ্ড হিমে আর অসহ্য গরমে রংটা জ্বলে গেছে।
লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সে যে মারাত্মক রকমের বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর, দেখামাত্র টের পাওয়া যায়। তার এক কাঁধে ক্রিকেটারদের কিট ব্যাগের মতো ক্যানভাসের ঢাউস একটা ব্যাগ। আরেক কাঁধে লম্বাটে একটা বাক্স যেটার নিচের দিক চওড়া, তবে ক্রমশ সরু হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে। তার ডান হাতের চওড়া কবজিতে স্টিল ব্যান্ডে আটকানো একটা চৌকো ঘড়ি।
লোকটা ফাঁকা হল-ঘরের এধারে ওধারে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ে সুবর্ণা আর দেবীর ওপর। মুহূর্তে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়।
সুবর্ণাও পলকহীন লোকটাকে লক্ষ করছিল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে তিনটে সিঁড়ি পেরিয়ে ল্যান্ডিংটায় এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে দেবীও রয়েছে।
সুবর্ণা তীব্র গলায় এবার বলে, কে আপনি? এ বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?
লোকটা নিজের ঠোঁটের ওপর ডান হাতের তর্জনী রেখে সুবর্ণাকে নীরব থাকতে ইঙ্গিত করে। তারপর তার চোখে আগের মতোই চোখ রেখে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে সিঁড়ির তলায় এসে দাঁড়ায়।
লোকটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণা। তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকেই মুখ বুজে থাকতে বলছে। লোকটার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে, থাকতে পারে। এ বাড়িতে দুজন অসুস্থ বৃদ্ধ, রান্নাবান্না এবং ছোটখাট ফাইফরমাস খাটার জন্য মাঝবয়সী একটি মেয়েমানুষ যার নাম মায়া আর সে এবং দেবী ছাড়া অন্য কেউ নেই এই মুহূর্তে। হরেনটাও কোথায় বেপাত্তা হয়ে আছে কে জানে। সুবর্ণা যদি চেঁচিয়ে গলার শির ছিঁড়েও ফেলে কেউ সাহায্য করতে আসবে না। কেননা তার চিৎকার শহর পর্যন্ত পৌঁছুবার আদৌ কোনও সম্ভাবনা নেই। লোকটাকে দেখে যা মনে হচ্ছে, নার্ভাস হয়ে হইচই বাধালে কিংবা রাগের মাথায় কিছু করে বসলে সে তাদের ছেড়ে দেবে না। তার চোখে মুখে যে ধরনের চিরস্থায়ী নিষ্ঠুরতা রয়েছে তাতে মারাত্মক কোনও দুর্ঘটনা তার পক্ষে। ঘটিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়। কাজেই এখন মাথা ঠান্ডা রাখাটা ভীষণ জরুরি। সুকৌশলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটাকে বাড়ি থেকে বের করতেই হবে।