পেশেন্টকে দেখা হয়ে গেলে ডাক্তার দত্তরায় বলেছিলেন, এখনই ওঁকে নার্সিংহোমে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করতে হবে।
বিক্রম নেই, শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ থেকেও না থাকার মতোই। সিদ্ধান্ত যা নেবার, সুবর্ণাকেই নিতে হবে। এক মুহূর্ত না ভেবে সে বলেছে, আপনি ব্যবস্থা করুন।
তক্ষুণি ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে প্রতাপপুর সিটির সব চেয়ে নামকরা নার্সিংহোমে সংগ্রামনারায়ণকে নিয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার দত্তরায়। তিনি এর সঙ্গে বহুকাল যুক্ত আছেন। নিজেও একজন বড় হার্ট-স্পেশালিস্ট। ওঁদের সঙ্গে সুবর্ণা আর হরেনও গিয়েছিল।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগী আর ডাক্তার ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। ডাক্তার দত্তরায় এবং আরও দু’জন স্পেশালিস্ট সংগ্রামনারায়ণকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন। সুবর্ণারা বাইরে অপেক্ষা করছিল। ঘণ্টাখানেক বাদে ওঁরা বেরিয়ে এসে জানিয়েছিলেন বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে পেশেন্ট সম্পর্কে কোনওরকম ভরসা দেওয়া সম্ভব হবে না।
সেদিনই আরও কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়েছিল। তাঁরা সংগ্রামনারায়ণের ব্লাড টেস্ট, ইসিজি, ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের যে লিস্ট দিয়েছিলেন তার জন্য অনেক টাকা দরকার। ব্যাঙ্ক থেকে বিক্রম বিরাট অ্যামাউন্ট সরিয়ে নিলেও ওদের অ্যাকাউন্টে তখনও প্রচুর রয়েছে। কয়েক লাখ। টাকা সরালে একটা দেড়শ বছরের পুরনো রাজবংশের সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু সুবর্ণার পক্ষে সেখান থেকে একটা পয়সাও তোলা সম্ভব নয়, কেননা তার নামে তো কিছু নেই। তবে কয়েক বছর কলেজে পড়াচ্ছে সে, মাইনের প্রায় সবটাই ব্যাঙ্কে জমিয়ে রেখেছে। অগত্যা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা টাকা তুলতে হয়েছিল।
ডাক্তাররা বাহাত্তর ঘণ্টার কথা বলেছিলেন কিন্তু তার আগেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল সংগ্রামনারায়ণের। ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছিল। হার্ট ক্রমশ স্থিতিশীল হতে শুরু করেছিল। চারদিনের মাথায় তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে এয়ার-কন্ডিশনড কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছিল।
কলেজ থেকে লম্বা ছুটি নিয়ে রোজ দু’বেলা নার্সিংহোমে গিয়ে কয়েক ঘন্টা করে কাটিয়ে আসত সুবর্ণা। প্রথমে তিনটে রাত হরেন আর সে তো সারা রাতই ছিল। কখন কী দরকার হবে, কে জানে। পরে সুবর্ণা যেত কিন্তু কেবিনে ঢুকত না। তাকে দেখলে সংগ্রামনারায়ণের প্রতিক্রিয়া কী হবে, এবং তার হার্টের পক্ষে সেটা ফের কতটা হানিকর হয়ে উঠবে বুঝতে পারছিল না সে। তবে ডাক্তার দত্তরায় তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। সংগ্রামনারায়ণ পুরোপুরি বিপন্মুক্ত হলে একদিন সুবর্ণার হাত ধরে তাঁর কেবিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই মেয়েটার জন্যে এবার প্রাণে বেঁচে গেলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সুবর্ণা কী কী করেছে, সব জানিয়ে দিয়েছিলেন।
ডাক্তার দত্তরায়ের হয়তো অভিপ্রায় ছিল, সুবর্ণাকে সংগ্রামনারায়ণ এরপর উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন; তাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। সুবর্ণা কিন্তু এসব নিয়ে একেবারেই ভাবেনি। সংগ্রামনারায়ণ সম্পর্কে তার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না। দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থেকে থেকে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। সংগ্রামনারায়ণের ব্যাপারে যা যা সে করেছে পরিচিত অন্য কেউ অসুস্থ হলে ঠিক তাই করত। মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক কিছু কর্তব্য তো থাকে। সংগ্রামনারায়ণের কাছে তার কোনও প্রত্যাশা ছিল না।
ডাক্তার দত্তরায়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন সংগ্রানারায়ণ কিন্তু একটি কথাও বলেননি। তবে বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল সুবর্ণার দিকে। কিন্তু তার মনোভাব বোঝা যাচ্ছিল না।
পরের দিন নার্সিংহোমে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। স্ট্রেচারে করেই তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। কেননা উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভাঙা তাঁর দুর্বল হার্টের পক্ষে হানিকর।
হরেনকে সঙ্গে নিয়ে নার্সিংহোমে শ্বশুরকে আনতে গিয়েছিল সুবর্ণা। ডাক্তার দত্তরায়ও তাঁকে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। একতলায় সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সে। সজ্ঞানে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় সংগ্রামনারায়ণ তার ওপরে ওঠাটা পছন্দ করবেন কি না বুঝতে পারছিল না। কিন্তু স্ট্রেচারে শোওয়া অবস্থাতেই তিনি সুবর্ণাকে বলেছিলেন, ওপরে এসো।
নিঃশব্দে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছিল সুবর্ণা।
দোতলায় এসে সংগ্রামনারায়ণকে তার বেডরুমে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তার দত্তরায় জানিয়েছিলেন, বড় ধাক্কাটা সামলে উঠেছেন তিনি, তবে এখন বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। কোনওভাবেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। একজন নার্সও ঠিক করে দিয়েছিলেন ডাক্তার দত্তরায়। সে সারাদিন থেকে ঘড়ি ধরে সংগ্রামনারায়ণকে ওষুধ খাওয়ানো স্নান করানো থেকে শুরু করে সন্ধের পর রাতের খাওয়া খাইয়ে ছুটি পাবে। তবে নার্সের ওপর ভরসা করলেই চলবে না, তাঁর যত্নের দিকে বাড়ির লোকদেরও লক্ষ রাখতে হবে।
ডাক্তার দত্তরায় চলে যাবার পর সংগ্রামনারায়ণ সুবর্ণাকে বলেছিলেন, আমার অসুখে প্রচুর খরচ হয়েছে। ডাক্তার বলছিল সব টাকাটাই তুমি দিয়েছ। কাল ব্যাঙ্কের লোকদের ডেকে তোমার টাকা দেবার ব্যবস্থা করব।