ঘন্টাখানেকও কাটেনি, সংগ্রামনারায়ণ ফিরে এসেছিলেন। তাকে খুবই অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। মুখ থমথমে, চোখ দু’টো টকটকে লাল। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। অস্থির পা দু’টো এত টলছিল যেন হুড়মুড় করে পড়ে যাবেন। হরেন ধরে ধরে, খুব সন্তর্পণে তাকে ওপরে নিয়ে গিয়েছিল।
দোতলায় উঠেই ফেটে পড়েছিলেন সংগ্রামনারায়াণ। তার একটানা, উত্তেজিত চিৎকারে গোটা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল যেন। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় তিনি সমানে কী বলছিলেন তার একটি বর্ণও বুঝতে পারছিল না সুবর্ণা। নিজের অজান্তেই যেন সিঁড়ির তলা পর্যন্ত ছুটে এসেছিল সে কিন্তু নিষেধাজ্ঞা তার মাথায় ছিল, তাই ওপরে ওঠেনি। অজানা ভয়ে, শঙ্কায় ভেতরে ভেতরে সে কুঁকড়ে গেছে।
যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎই দোতলায় সংগ্রামনারায়ণের তর্জনগর্জন, চেঁচামেচি থেমে যায়। অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে গোটা বাড়িটায়। তারপরই ওপর থেকে কাজের মেয়েদের ছোটাছুটি এবং ভয়ার্ত গলার হইচই ভেসে আসে। এক সময় দেখা যায়, ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নেমে আসছে মায়া। তার উদ্ভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিল সুবর্ণা।
ল্যান্ডিংয়ের মাঝামাঝি এসে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মায়া। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলেছে, আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম বৌদিদি। শীগগির ওপরে চলুন।
ভয়ঙ্কর কিছু যে ঘটে গেছে, সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। মায়ার উৎকণ্ঠা এবং ত্রাস তার মধ্যেও দ্রুত চারিয়ে যাচ্ছিল। কঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে?
ছোট বাবা অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
এটা ভাবা যায়নি। কিছু একটা যে এখনই করা উচিত সেটা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা কিন্তু দোতলায় ওঠাটা ঠিক হবে কিনা, সে সম্পর্কে তার যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। বে মায়া ফের তাড়া দিয়েছিল, এখন আর পুরনো কথা মনে করে রাখবেন না। বৌদিদি। আসুন–
সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী, শুধু মায়া কেন, এ বাড়ির সবাই জানত। সুবর্ণা আর দাঁড়িয়ে থাকেনি; বিয়ের চার বছর পর একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে দোতলায় চলে গিয়েছিল।
ওপরের হল-ঘরে, সংগ্রামনারায়ণ তার বেডরুমের সামনে চিত হয়ে পড়ে ছিলেন। চোখ দু’টো বোজা, সারা শরীর ঘামে ভেজা, গালের কষ বেয়ে ফেনা বেরিয়ে আসছিল। শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে কি না বোঝা যাচ্ছিল না।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো সুবর্ণার খুবই চেনা। কয়েক বছর আগে সে যখন কলেজে পড়ে, তার এক মামা তাদের শিলিগুড়ির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ তার ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়। সংগ্রামনারায়ণের মতোই তারও গা বেয়ে ঘামের ধারা নেমেছিল, গালের পাশে অবিকল এইরকম গাঁজলা।
সংগ্রামনারায়ণ সুবর্ণার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন, বিন্দুমাত্র মর্যাদা কখনও দেননি। তবু অচেতন, অসহায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে তার সারা শরীরে শিহরন খেলে যায়–সেটা উৎকণ্ঠায় এবং ভয়ে। দ্রুত সংগ্রামনারায়ণের নাকের সামনে হাতটা নিয়ে আসে সে। না, সব শেষ হয়ে যায়নি, তির তির করে নিঃশ্বাস পড়ছে।
এবার কাজের মেয়েদের সঙ্গে ধরাধরি করে সংগ্রামনারায়ণকে তার বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দেয় সুবর্ণা, তারপর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর হাউস-ফিজিসিয়ান ডাক্তার দত্তরায়কে ফোন করে। তাকে সে চিনত। কেননা উইকে তিনদিন তিনি এসে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ আর সংগ্রামনারায়ণকে দেখে যেতেন। নিয়মিত যাতায়াতের। কারণে এ বাড়িতে সুবর্ণার স্টেটাসটা কী, সেটা তারও অজানা ছিল না।
ডাক্তার দত্তরায়ের বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। মোটাসোটা ভারী চেহারা, মাঝারি হাইট, রং টকটকে ফর্সা, মুখ নিখুঁত কামানো। পরনে সারাক্ষণ কালো ঢোলা ট্রাউজার্স আর ডবল-কাফওলা সাদা ধবধবে ফুলশার্ট যার হাতার বোতাম কখনও লাগানো থাকত না। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। তিনি এসে দোতলায় সুবর্ণাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলেননি। তবে পেশেন্টকে পরীক্ষা করতে করতে তাঁর মুখচোখের চেহারা পালটে গিয়েছিল। খুবই চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরশু ওঁকে দেখে গেছি; বেশ ভাল ছিলেন। হঠাৎ এরকম হল কী করে? কোনও কারণে হঠাৎ এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলেন কি?
সংগ্রামনারায়ণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার পর যা যা ঘটেছে সব বলে গিয়েছিল সুবর্ণা। তিনি ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যান। তবে তার ক্রোধ বা উত্তেজনার কারণটা সুবর্ণার জানা নেই।
এ বাড়ির পুরুষ কাজের লোকেদের বিনা হুকুমে দোতলায় ওঠা বারণ। তবে হরেনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, ডাক্তার দত্তরায় এলে সে তার ব্যাগ বয়ে ওপরে নিয়ে আসবে। সেদিনও সে এসেছিল এবং সুবর্ণাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল।
সংগ্রামনারায়ণের আকস্মিক উত্তেজনা সম্পর্কে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল হরেন; কী ভেবে চুপ করে যায়। পরে অবশ্য সুবর্ণাকে একা পেয়ে যা জানিয়েছিল তা এইরকম। রাজ-পরিবারের চারটে শিডিউল্ড এবং একটা বিদেশী। ব্যাঙ্কে যত অ্যাকাউন্ট ছিল–সেভিংস এবং ফিক্সড সবই জয়েন্ট; এক সঙ্গে সংগ্রামনারায়ণ আর বিক্রমের নামে। ব্যবস্থা এমন করা হয়েছিল, যে কেউ একজন চেক সই করে টাকা তুলতে পারত। সংগ্রামনারায়ণ ব্যাঙ্কে যাওয়া পছন্দ করতেন না। বিক্রমই দরকারমতো যেত। তবে রুবিকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবার পর হাতের টাকা ফুরিয়ে এলে সংগ্রামনারায়ণকে সেদিন একটা ব্যাঙ্কে ছুটতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে যান। তাকে না জানিয়ে সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে তো বটেই, ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙেও প্রচুর টাকা তুলে নিয়েছে বিক্রম। সন্দেহ হওয়ায় অন্য ব্যাঙ্কগুলোতেও গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। সব জায়গাতেই এক অবস্থা। সব মিলিয়ে কয়েক লাখ টাকা। তুলেছে বিক্রম। তাছাড়া লকার থেকে প্রচুর দামী দামী জুয়েলারি এবং তার নামে। বড় বড় মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির যেসব শেয়ার কেনা হয়েছিল সেগুলো নিয়েও চলে গেছে। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় বাড়ি এসে ফেটে পড়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ এবং সঙ্গে সঙ্গে হার্ট-অ্যাটাক।