অপমানে, রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুবর্ণার। কিছু একটা রূঢ় জবাব দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু গলায় স্বর ফোটেনি।
মানসিক দিক থেকে সুবর্ণা যখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত তখন হঠাৎ একদিন রুবিকে নিয়ে বিক্রম উধাও হয়ে যায়। এমন খারাপ সময় তার জীবনে আগে আর কখনও আসেনি।
দাদা অভিজিৎ কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে ব্যাঙ্কে জুনিয়র অফিসার হিসেবে ঢুকেছিল। তার প্রথম পোস্টিং ছিল শিলিগুড়িতে। সুবর্ণার যখন দুঃসময় শুরু হল, তার কিছুদিন আগে তাকে দিল্লিতে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। শিলিগুড়ির বাড়ি ভাড়া দিয়ে মা, বৌদি আর দু’বছরের ছেলে টুপাইকে নিয়ে সে সেখানে চলে যায়।
দাদা এবং বৌদি দু’জনেই ভাল মানুষ–উদার, সহৃদয়, স্নেহপ্রবণ। সুবর্ণা একবার ভেবেছিল দেবীকে নিয়ে সেখানে চলে যাবে। ওরা কখনও তাদের অবাঞ্ছিত ভাববে না। তাছাড়া একসঙ্গে থাকলেও নিজেদের ব্যবস্থা সুবর্ণা করে নিতে পারবে। ইউনিভার্সিটিতে তার যা রেজাল্ট সেই জোরে দিল্লির কোনও কলেজ বা কমার্শিয়াল ফার্মে একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু চিরকাল অন্যের কাঁধে, সে যত আপনজনই হোক, ভর করে থাকাটা অস্বস্তিকর। তার সঙ্গে আত্মসম্মানের প্রশ্নও রয়েছে। তাছাড়া, মা, দাদা তার বিয়েতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। বার বার ওরা সতর্ক করে দিলেও সুবর্ণা কানে তোলেনি। এখন দাম্পত্য জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওদের কাছে গিয়ে মুখ দেখাবে কী করে? হঠাৎ নিজের মনকে খুবই দৃঢ় করে নিয়েছিল সে। প্রতাপপুর থেকে পালিয়ে যাবে না; সব কিছুর শেষ দেখে ছাড়বে।
হিংসুটে কলিগরা কিন্তু সুবর্ণার বিবাহিত জীবনের বিপর্যয়ে দারুণ খুশি। সামনাসামনি তারা কিছু বলেনি, এমনকি মৃন্ময়ী বড়ালের মতো পরশ্রীকাতর মহিলাও নয়। তবে তাদের চোখেমুখে যে চাপা বিদ্রূপ এবং উল্লাস ফুটে বেরিয়েছিল তা ছুরির ফলার মতো বুকের ভেতর পর্যন্ত বিধে গেছে। বাইরের রক্তপাত চোখে পড়ে কিন্তু ভেতরের রক্তক্ষরণ কেউ কি দেখতে পায়? হিতাকাঙ্ক্ষীরা অবশ্য তার যন্ত্রণাটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। অপার সহানুভূতি আর সমবেদনায় তারা সর্বক্ষণ সুবর্ণার পাশে থেকেছে। বিশেষ করে বিমলেশ। সে তাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। বুঝিয়েছে জীবনটা এক বা দুই রাউন্ডের লড়াই নয়, দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধ। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সুবর্ণা ঝাড়া হাত-পা মহিলা নয়। তার একটি মেয়ে আছে। তাকে মানুষ করতে হবে। সে জন্য নিজেকে সারাক্ষণ সতেজ, সজীব এবং তৎপর রাখা দরকার। একটি লম্পটের কারণে নিজেকে চুরমার করে ফেলার মানে হয় না। নিজের এবং মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য শরীর এবং মনের সবটুকু শক্তি সংরক্ষণ করাটা খুবই জরুরি। তা ছাড়া সুবর্ণা কোনও অপরাধ করেনি। অন্যায়, ইতরাম, বজ্জাতি, যা করার করেছে বিক্রম। সঙ্কোচে, লজ্জায়, সুবর্ণার মুখ লুকিয়ে রাখার কারণ নেই। কে কী মন্তব্য করল, কে ব্যঙ্গের হাসি হাসল, এসব পরোয়া করতে হবে না।
বিক্রমের চলে যাওয়াটা দোতলায় কী প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল, নিচে থেকে ঠিক টের পায়নি সুবর্ণা। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে এই ঘটনা এতটুকু নাড়া যে দেবে না সেটা সে জানত। তবে সংগ্রামনারায়ণ এটাকে কীভাবে নিয়েছেন, বোঝা যাচ্ছিল না। সে জন্য বেশ খানিকটা উৎকণ্ঠায় ছিল সুবর্ণা। অন্য দিক থেকেও মানসিক একটা চাপ ছিল। বিক্রম নেই, অবাঞ্ছিত পুত্রবধুকে সংগ্রামনারায়ণ বাড়িতে থাকতে দেবেন কি না কে জানে। মায়ার কাছে এইটুকুই শুধু জানা গিয়েছিল, তিনি একেবারে গুম হয়ে গেছেন, সর্বক্ষণ নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন।
মনে পড়ে, মাসখানেক এভাবে কাটার পর একদিন দুপুরের কিছু আগে, তখন সাড়ে দশটা কি এগারটা হবে, নিজের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল সুবর্ণা। কলেজের ফাউন্ডেশন ডে থাকায় সেদিনটা তার ছুটি। দেবীও বাড়ি নেই, একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। চপলা তাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, তখনও ফিরে আসেনি।
সুবর্ণার বেডরুমের হল-ঘরের দিকের দরজাটা পুরো খোলা ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, হরেনের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন সংগ্রামনারায়ণ। প্রায় চার বছরের মতো এ বাড়িতে কেটে গেছে সুবর্ণার, কিন্তু ক্কচিৎ তাকে প্যালেসের বাইরে যেতে দেখেছে সে। গেলেও বিকেলের দিকে। এ সময় কখনই নয়। সুবর্ণা বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিল।
তখনও এ বাড়িতে তিনটে গাড়ি ছিল। একটা পুরনো মডেলের ফোর্ড, একটা স্টুডিবেকার, অন্যটা দিশি অ্যামবাসাডর। স্টুডিবেকার আর ফোর্ডটা কখনও সখনও বার করা হত। সংগ্রামনারায়ণ বাইরে বেরুলে অ্যামবাসাডারটাই চড়তেন। বিক্রম যতদিন ছিল, সে-ও ওটাই চালাত। বাড়িতে গাড়িতে দু-চার বারের বেশি চড়েনি সুবর্ণা। বিক্রম জোর করেছে বলে চড়তে হয়েছে। যেখানে তার অধিকারটাই অনেকখানি অনিশ্চিত কিংবা সীমাবদ্ধ সেখানে থাকাটুকু ছাড়া গাড়ি চড়ার মতো আরামের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়াটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। সে লোভী নয়।
সুবর্ণা লক্ষ করেছে, নিচে নেমে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা বাইরে চলে গিয়েছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। কিছুক্ষণ পর গাড়ির আওয়াজ শুনে মনে হয়েছিল সেটা গেটের বাইরে বেরিয়ে গেছে।