পলকহীন বিক্রমের দিকে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছিল সুবর্ণা।
বিক্রম থামেনি, বংশের কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যেগুলো ঘুরে ঘুরে পরের জেনারেশনের মধ্যে ফিরে আসে। ঠাকুরদার আগে ফোর-ফাদারদের সেই প্যাসনটা দু’টো জেনারেশনকে টপকে আমাকে ধরে ফেলেছে।
সুবর্ণার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল। এমন নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি যে কেউ করতে পারে, সেটা শুনেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। এই লোকটাই কি একদিন প্রেমিক ছিল, তাকে পাগলের মতো ভালবেসেছিল, তার জন্য রাজবংশের ট্র্যাডিশন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল? বিক্রমের চোখে চোখ রেখে সে বলেছে, তুমি নিজেকে তোমার পূর্বপুরুষদের মতো লম্পট মনে কর?
বিক্রম হেসে হেসে বলেছে, মেয়েদের সম্বন্ধে একটু বেশি ইন্টারেস্ট দেখালে যদি লম্পট বলা হয়, ধর আমি তা-ই। আমি যে দেবশিশুর মতো নিষ্পাপ নই সেটা বিয়ের আগে তোমার কলিগদের কেউ কেউ শুনিয়ে দেয়নি?
শুনিয়েছে। তবে আমি গ্রাহ্য করিনি। পাস্ট নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তোমাকে বিয়ের পর তিন বছর দেখেছি। অভিযোগ করার মতো কিছু পাইনি। বলে একটু থেমে ফের শুরু করেছে সুবর্ণা, আমার কথা বাদ দিলেও তোমার একটা বাচ্চা আছে। নিজেকে কন্ট্রোল কর। রুবির সঙ্গে মেলামেশাটা তোমাকে বন্ধ করতে হবে।
বিক্রমের চোখে আগুনের একটা ঝলক চকিতের জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, কাকে কী বলছ তুমি বোধহয় জানো না। লিমিট ছাড়াবার চেষ্টা করো না।
তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা ঠান্ডা কাঠিন্য ছিল যে চমকে উঠেছে সুবর্ণা। রাজতন্ত্র শেষ হয়ে গেলেও সে যে একজন কমোনার নয় সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল বিক্রম। তার মধ্যে লুকনো রাজবংশের দম্ভটা রক্তের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল যেন। ভয়ে ভয়ে সুবর্ণা বলেছে, রুবিকে জড়িয়ে তোমার কত স্ক্যান্ডাল রটছে সেটা কি তুমি জানো?
এই ধরনের স্ক্যান্ডাল রয়াল ফ্যামিলির একটা ইনএভিটেবল কোয়ালিটি। অর্ডিনারি পিপলের কাছে হয়তো মারাত্মক ক্রাইম। এ নিয়ে মাথা ঘামিও না।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সুবর্ণার। কিছুক্ষণ বিমর্ষ হয়ে থাকে সে। তারপর বলে, আমার কী হবে?
বিক্রম বলেছে, কী আবার হবে। তুমি যেমন আছ তেমনি থাকবে।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব? নিশ্চয়ই।
রুবির সঙ্গে তোমার রিলেশানটা কতদূর এগিয়েছে?
বিক্রম ঠান্ডা গলায় বলেছিল, যতদুর এগুলে স্ক্যান্ডালের স্টেজে পৌঁছে যায় ঠিক ততটাই। একটু থেমে ফের বলেছে, তোমার মাথায় মিডল ক্লাসের কিছু ট্যাবু এখনও অ্যাক্টিভ রয়েছে। ওগুলো মাথা থেকে বার করে দিতে পারলে দেখবে আর কোনও প্রবলেম নেই।
সুবর্ণা বলেছিল, এটা ঠিক, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে পূর্বপুরুষের কিছু কিছু সংস্কার ঢুকে যায়। সেগুলো তার সহজাত; মুখের কথায় এসব কাটিয়ে ওঠা যায় না। সে আরও বলেছে, তুমি বললে তোমাদের বংশের লাম্পট্যের সাইকেলটা তোমার মধ্যে ফিরে এসেছে। রাজত্ব নেই কিন্তু লেচারিটা আছে। ওটা এমন কিছু মহৎ ব্যাপার নয় যে চিরকাল আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।
বিক্রম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, উত্তর দেয়নি।
সুবণা থামেনি, আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে জেনেই কিন্তু তুমি বিয়েটা করেছিলে।
বিক্রম এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে, প্লিজ স্টপ ইট।
গলা চড়িয়ে তুমি আমাকে থামাতে পারবে না। হিন্দু কোড রিল অনুযায়ী আমি তোমার লিগাল ওয়াইফ। তা হলে রুবির স্টেটাসটা কী হবে–তোমার রক্ষিতা? নাকি আমাকে ডিভোর্স করে তাকে বিয়ে করতে চাও?
রুবিকে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তোমাকে তো বলেছি, যেমন আছ তেমনি থাকবে।
সুবর্ণা উত্তেজনায় ফেটে পড়েনি। শান্ত গলায় এবার বলেছে, তোমার বাবা আমাকে এখনও মেনে নেননি। তুমি হঠাৎ রুবিকে নিয়ে মেতে উঠেছ। তার মানে অসম্মান আর উপেক্ষার মধ্যে আমাকে এ বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে।
বিক্রম চুপ।
সুবর্ণা সমানে বলে যাচ্ছিল, আমি আমার মা-বাবা দাদাকে ছেড়ে সবার আপত্তি সত্ত্বেও তোমার জন্যে এ বাড়িতে চলে এসেছিলাম। হিন্দু কোড বিল আমার মতো মেয়েদের কিছু শক্তি দিয়েছে। আমি কিন্তু সহজে তোমাকে ছাড়ব না।
বিক্রম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলেছিল, তা হলে শক্তিটা পরীক্ষা করে দেখতে পার।
এরপর রুবিকে ফোন করে বোঝাতে চেষ্টা করেছে সুবর্ণা। অন্য একটি মেয়ের দাম্পত্য জীবন, স্বামী এবং সন্তান নিয়ে তার সংসার সে যেন ভেঙে চুরমার করে না দেয়। রুবি হা না কিছুই বলেনি, চুপচাপ শুনে গেছে শুধু। সুবর্ণা বুঝতে পারছিল মেয়েটা বিক্রমের ব্যাপারে এমনই মোহাচ্ছন্ন যে কার কতটা ক্ষতি হবে তা নিয়ে ভাবার মতো সময় নেই তার। কিংবা এতে তার কিছুই আসে যায় না। সুবর্ণার একবার মনে হয়েছিল, বিক্রম যে কত বড় লম্পট, দুশ্চরিত্র একদিন তার মতো রুবিকেও ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে-এসব জানিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপ্রিয় কথাগুলো আর বলেনি।
ফোনের খবরটা রুবির কাছ থেকে পেয়ে গিয়েছিল বিক্রম। সে প্রচণ্ড খেপে গেলেও বাইরে তার প্রকাশ ছিল না। শীতল কণ্ঠস্বরে শুধু বলেছিল, শেম! তোমার মতো একজন তেজী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলার পক্ষে স্বামীর প্রেমিকার কাছে করুণা ভিক্ষে করাটা সম্মানজনক নয়।