এই তিন বছরে দু’টো বড় ঘটনা ঘটেছিল তার জীবনে। বাবার মৃত্যু এবং দেবীর জন্ম। মৃত্যু সংবাদটা পেয়েই তাকে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়েছিল বিক্রম। শ্রাদ্ধের পর প্রতাপপুর ফিরে আসে। বাবা মারা যাবার বছরখানেক বাদে দেবী হয়েছিল। তার জন্মের দু’মাস আগে সে আবার শিলিগুড়িতে যায়। এবার ফেরে দু’মাসের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। দ্বিতীয় বার গিয়ে মায়ের কাছে চার মাস কাটিয়ে এসেছিল সে। ফিরে আসার পর এমন দু’টো ব্যাপার ঘটল যা তার জীবনকে আগাগোড়া বদলে দেয়। প্রথমটা দারুণ চমকপ্রদ।
দু’মাসের বাচ্চাকে একা রেখে কলেজে যাওয়া যায় না! দেবীর দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল আধাবয়সী চপলাকে। অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কাজ নিয়েছিল সে। অত্যন্ত দায়িত্বশীল, নম্র এবং বিশ্বাসী। দেবীকে খুব যত্ন করত। ঘড়ি ধরে তার খাওয়া, স্নান, ঘুম–এসব নিয়ে সুবর্ণার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা। ছিল না। সে জানত উপযুক্ত মানুষের হাতেই মেয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
চপলা এমনিতে ধীর, স্থির কিন্তু একদিন কলেজ থেকে ফেরার পর সুবর্ণা লক্ষ করল, তাকে ভীষণ চঞ্চল দেখাচ্ছে, চোখে মুখে প্রবল উত্তেজনার ছাপ। এদিক সেদিক ভাল করে দেখে, সুবর্ণার হাত ধরে ঘরের কোণে টেনে নিয়ে চাপা গলায় সে বলেছিল, আজ কী হয়েছে জানেন বৌদিদি?
চপলার এ জাতীয় আচরণ তার স্বভাবের সঙ্গে মেলে না। খুব অবাক হয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে?
ছোট বাবা দুপুরবেলায়, আপনি যখন কলেজে, একতলায় এসে দেবী মাকে দেখে গেছেন।
এ বাড়িতে কাজের লোকেরা সবাই শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে বড় বাবা, সংগ্রামনারায়ণকে ছোট বাবা, আর বিক্রমকে দাদা বলত।
খবরটা এতটাই বিস্ময়কর যে অনেকক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। তারপর বলেছে, কী বলছ তুমি!
সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী ধরনের সেটা প্রতাপপুর । প্যালেস’-এর কাজের লোকেদের জানতে বাকি নেই। চপলা বলেছিল, সত্যিই বৌদিদি। দেবী মা তখন ঘুমোচ্ছিল। কম করে আধ ঘন্টা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখলেন। চোখের পাতা পড়ছিল না গো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে ওপরে চলে গেলেন।
সুবর্ণার মনে হয়েছিল, আগ্নেয়গিরির উত্তাপ হয়তো জুড়াতে শুরু করেছে। কিংবা এমনও হতে পারে, মিডল ক্লাস কমোনার বলে তাকে মেনে না নিলেও। দেবীকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে বুঝিবা সম্ভব হয়নি; কেননা মেয়েটার শরীরে রাজবংশের রক্তধারা বয়ে চলেছে যে।
প্রথমটা যদি মোটামুটি আনন্দদায়ক হয়, দ্বিতীয় ঘটনাটি সুবর্ণার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল। দেবীকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পর বিক্রম সম্পর্কে উড়ো কিছু খবর তার কানে আসছিল। এমনকি বেশ ক’টা বেনামী চিঠি পেয়েছিল সে। বিক্রম নাকি অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ভীষণ মাতামাতি করছে। মেয়েটা কে, কষ্ট করে খোঁজখবর নিতে হয়নি। মৃন্ময়ীই যেচে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল। প্রতাপপুর সিটিতে একটা নামকরা ফরেন ব্যাঙ্কের নতুন যে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারটি এসেছেন, মেয়েটা তার শালীনাম রুবি। যেমন স্মার্ট, তেমনি দুর্ধর্ষ ফিগার তার, সারা শরীরে চুম্বকের মতো সেক্স অ্যাপিল। দিল্লিতে থাকে, সবে এম. এ পরীক্ষা দিয়েছে, রেজাল্ট বেরুবে তিন মাস পর। সময় কাটাতে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছিল। সুবর্ণাকে দেখে একদিন যেমনটা হয়েছিল, রুবিকে দেখে অবিকল তেমনই ঘাড় গুঁজে পড়েছিল বিক্রম।
মৃন্ময়ী তীব্র, নিচু গলায় বলেছে, রাজপুত্রকে বিয়ে করলে কিছু দাম তো দিতেই হয়। এসব গায়ে মেখো না সুবর্ণা। তার মুখে জ্বালা-ধরানো হাসিটি লেগেই ছিল।
কেতকী আর নবনীতা অবশ্য অমন চাছাছোলা ভাষা ব্যবহার করেনি। মুখখানা করুণ করে বলেছিল, কী যে সব শুনছি! বড্ড খারাপ লাগছে। তাদের আক্ষেপের পেছনে চাপা খুশি যে লুকনো ছিল, টের পেতে অসুবিধা হয়নি।
তবে সত্যিকারের যারা হিতাকাঙ্ক্ষী, যেমন নিরুপম, মাধুরী বা বিমলেশরা কিন্তু খুবই দুঃখ পেয়েছিল। তারা আন্তরিকভাবে পরামর্শ দিয়েছে, সুবর্ণা যেন ভেঙে না পড়ে। যেমন করে থোক, রুবির কাছ থেকে বিক্রমকে ফিরিয়ে আনে।
কিন্তু রুবির কথা তুলতে গোড়ার দিকে হেসে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে বিক্রম। সুবর্ণা তাকে ছাড়েনি। ক্রমাগত চাপ দিতে হঠাৎ একদিন তার একটা হাত ধরে টানতে টানতে হল-ঘরের দেওয়ালে সাজানো অয়েল পেন্টিংগুলোর কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো দেখাতে দেখাতে বলেছে, এঁরা কারা নিশ্চয়ই তুমি জানো?’
ছবির এই গ্যালারিতে কেন তাকে ধরে আনা হয়েছে, বুঝতে না পেরে সুবর্ণা প্রথমটা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর বলেছে, জানব না কেন? এঁরা তোমার সব পূর্বপুরুষ–
রাইট, রাইট, রাইট। এঁদের ক্যারেক্টার কেমন ছিল, সেটা বোধহয় তোমাকে বলা হয়নি।
সুবর্ণা উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে ছিল।
বিক্রম হেসে হেসে বলেছে, আমার এই লেট ল্যামেন্টেড গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারেরা ছিলেন একেকটি স্কাউন্ট্রেল। এদের মতো বিখ্যাত লম্পট হোল ইন্ডিয়াতে খুব বেশি ছিল না। কলকাতা, দিল্লি, বেনারসে কত বাঈজি আর রক্ষিতা যে পুষতেন তার হিসেব নেই। সেক্সি, বিউটিফুল ইয়াং উইমেনের শরীর ছাড়া জীবনে আর কিছু বুঝতেন না। তাদের একমাত্র প্যাসন ছিল মেয়েমানুষ। আমার ঠাকুরদা আর বাবা কিন্তু একেবারে অন্য টাইপের। রাজবংশের প্রাইড নিয়ে একটা অদ্ভুত মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ড তৈরি করে তার ভেতর লাইফ কাটিয়ে দিচ্ছেন। ঠাকুরদার বোধবুদ্ধি, মেমোরি অবশ্য নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যেভাবে বেঁচে আছেন তার কাছে বংশগৌরব টৌরব টোটালি মিনিংলেস।