মজার গলায় নিরুপম বলেছেন, আরে ভাই, তোমার মাধুরীদি আর আমিও চুটিয়ে প্রেম করে বিয়েটা করেছিলাম। আর সেটা গলা ফাটিয়ে কাউকে জানাতে বাকি রাখিনি। কিন্তু তোমরা এত লুকোচুরি খেললে কেন, মাথায় ঢুকছে না। আরে ভাই, ভালবাসার বিয়েটা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে কোনও দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। নো পানিশেবল অফেন্স। কথায় কথায় আরে ভাইটা তাঁর মুদ্রাদোষ।
ভীষণ বিব্রত বোধ করেছে সুবর্ণা। বলেছে, কী অবস্থায় আমাদের বিয়েটা হয়েছে, পরে শোনাব। তবে এটুকু বলতে পারি, কাউকে আগে জানাবার উপায় ছিল না।
পলিটিক্যাল সায়েন্সের আদিনাথ বসুমল্লিকের জীবনে খাওয়াটা টপ প্রায়োরিটি। সাতচল্লিশ আটচল্লিশ বছরের এই প্রৌঢ়টি সম্পর্কে জনরব, স্ত্রী এবং ছেলেপুলেদের ভাল ভাল সুখাদ্যের ভাগ দিতে হবে বলে বিয়েটাই আর করলেন না। আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, কত জায়গায় নেমন্তন্ন খেয়েছি কিন্তু রাজবাড়ির ভোজ কখনও খাওয়া হয়নি। সুবর্ণা, চান্সটা হাতে এসেও ফসকে গেল।
সুবর্ণা খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। একবার ভেবেছিল বলে, বিক্রমের সঙ্গে পরামর্শ করে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কলিগদের আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু পরক্ষণে সংগ্রামনারায়ণের ক্রুদ্ধ, নির্দয় মুখটা মনে পড়ায় তার সব উৎসাহ এক ছুঁয়ে নিভে গিয়েছিল।
বেয়াল্লিশ বছরের বেজায় কালো, বেঢপ, ধুমসী থাইরয়েডের পেশেন্ট মৃন্ময়ী বড়াল ভূগোল পড়ায়। তার চেহারাটা বিয়ের অনুকূল নয়, তাই চিরকুমারী। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে, কিন্তু ভেতরটা একেবারে বিষের পাত্র। সুন্দর, মহৎ, মনোগ্রাহী–এই ধরনের কোনও কিছুই সহ্য করতে পারে না সে। এমন কুচুটে, হিংসুটে মহিলা ক্কচিৎ চোখে পড়ে। হেসে হেসে বলেছিল, লুকিয়ে বিয়ে না করে উপায় ছিল? প্রতাপপুর স্টেটের প্রিন্স মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েকে কুলবধূ করে প্যালেসে নিয়ে আসবে, আগে জানতে পারলে সংগ্রামনারায়ণ সিংহ ঘাড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দিত না? তা সুবর্ণা, শ্বশুরবাড়ির আদর টাদর কেমন লাগছে?
রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এর অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের বেশির ভাগই এসেছে বাইরে থেকে। মৃন্ময়ী কিন্তু এই শহরেরই মেয়ে। রাজবাড়ির যাবতীয় খুঁটিনাটি খবর থেকে রাজ-পরিবারের কে কেমন মানুষ, তাঁদের স্বভাবচরিত্র, সব তার জানা।
মৃন্ময়ীর কথায় তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা ছিল। বিশাল স্টাফ রুমটায় হঠাৎ স্তব্ধতা নেমে এসেছে। মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল, সবাই ভীষণ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন।
ইকনমিকসের বিমলেশ ভট্টাচার্য ছিল সুবর্ণার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তার থেকে বছর তিনেকের বড়। একই দিনে তারা রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ চাকরি নিয়ে এসেছিল। মাধুরীর মতো বিমলেশও একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ–উদার, সহৃদয়, ভদ্র। অযাচিতভাবে সবাইকে সাহায্য করে। সুবর্ণার সত্যিকারের একজন বন্ধু। স্টাফ রুমের গুমোট আবহাওয়াটাকে হালকা করে দেবার জন্য বলে উঠেছিল, মৃন্ময়ীদি, প্লিজ ওসব কথা বলবেন না। আসুন, সুবর্ণাকে আমরা সকলে শুভেচ্ছা জানাই। শাদি মুবারক।
অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা এবার একসঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেছিলেন হা হা, নিশ্চয়ই। কনগ্রাচুলেশন সুবর্ণা। মৃন্ময়ী কিন্তু কিছু বলেনি, সে শুধু হাসছিল, আর হাসতে হাসতে তার চোখ দু’টো কুঁচকে যাচ্ছিল। হয়তো হিংসায়, হয়তো বিদ্বেষে।
বাংলার কেতকী ধর আর ফিজিক্সের নবনীতা পুরকায়স্থ সুবর্ণার চেয়ে তিন চার বছরের বড়। তারাও যে এ বিয়েতে খুশি হয়নি, সেটা খুব ভাল করেই জানত সুবর্ণা। বিক্রমের সঙ্গে যখন তার উতরোল প্রেম-পর্ব চলছে তখন প্রায়ই তাদের চোখে আগুনের ঝলক দেখা দিয়ে মিলিয়ে যেত। তার কারণ যে হতাশা কিংবা অন্য কোনও তীব্র প্রতিক্রিয়া, বুঝতে অসুবিধা হত না। সুবর্ণা যেন হঠাৎ প্রতাপপুরে এসে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়েছে।
যতই ঈর্ষাকাতর হোক, কেতকী আর নবনীতা ছিল খুবই চতুর। নিজেদের মনোভাব তারা গোপন রাখতে জানত। এমনকি যখন স্টাফ-রুমে সবাই সুবর্ণাকে বিয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছে, তারাও হেসে হেসে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে তাতে যোগ দিয়েছিল।
মজার গলায় বিমলেশ এরই মধ্যে জিজ্ঞেস করেছে, রাজবাড়ির বৌ হলে। এবার থেকে কি হার হাইনেস বলতে হবে?
সুবর্ণা মিষ্টি করে ধমক দিয়ে বলেছিল, ইয়ার্কি কোরো না বিমলেশ।
শুধু রাজবাড়ি বা কলেজেই না, এই বিয়েটা প্রতাপপুর সিটিকেও যে তোলপাড় করে ফেলেছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। অফিসে, চায়ের দোকানে, বার লাইব্রেরিতে, পাড়ার ক্লাবে, মেয়ে মহলে–সর্বত্র এই নিয়ে তুমুল হইচই। এও শোনা যাচ্ছিল, বিয়েটা টিকবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’ থেকে সুবর্ণাকে বার করে দেওয়া হল বলে।
উত্তেজনা, গুজব, গসিপ–চিরকাল এসব একই রকম চড়া তারে বাঁধা থাকে না। তার আঁঝ ক্রমশ কমে আসে। সুবর্ণার বেলাতেও তাই হয়েছিল। মাসখানেক পর থেকে তার ব্যাপারে কেউ আর মাথা ঘামাতো না। নতুন নতুন উত্তেজনা এসে তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।
বিয়ের পর তিনটে বছর চোখের পাতা পড়তে না পড়তেই যেন উড়ে গেছে। এতটা সময় কেটে গেল কিন্তু একবারও সে দোতলায় ওঠে নি। সংগ্রামনারায়ণও। যেতে বলেননি। আগের মতোই যেন হোটেলে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিল। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল সুবর্ণা।