এদিকে মা, বাবা এবং দাদা শ্বশুরবাড়িতে সুবর্ণা কেমন আছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য শিলিগুড়ি থেকে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ এসেছিলেন। মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তারা যখন দোতলায় যেতে চাইলেন, বিক্রম বিব্রতভাবে বারণ করেছিল। কিন্তু শিষ্টাচার বলে একটা কথা আছে। এতদূর এসে কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে মেয়ের শ্বশুর এবং দাদাশ্বশুরের সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা। তারা দোতলায় উঠতেই কুকুর বেড়ালের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবা-মা এরপর আর কখনও এ বাড়িতে আসেননি।
সংগ্রামনারায়ণ মায়াকে দিয়ে সুবর্ণাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার বাপের বাড়ি থেকে কেউ যেন ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ না আসে। মা-বাবা বা অন্য আত্মীয়স্বজন না এলেও দাদা কিন্তু মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেত। নিষেধাজ্ঞা সে মানে নি। দাদার কাছেই জানা গেছে মা-বাবা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীষণ শঙ্কিত; তারা একেবারে ভেঙে পড়েছেন।
এই দুঃসময়ে বিক্রম কিন্তু সারাক্ষণ সুবর্ণাকে আগলে আগলে রেখেছে। বিয়েটা ঘিরে যে উত্তেজনা এবং অশান্তি চলছিল তার কোনওরকম আঁচ যাতে তার গায়ে না লাগে সেদিকে বিক্রমের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। সুবর্ণার দাম্পত্য জীবনের এটাই ছিল সবচেয়ে সেরা সময়।
ছুটির মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছিল। একদিন দুপুরবেলায় খাওয়ার পর সে ঘুমোচ্ছে, বিক্রম বাড়ি নেই, হঠাৎ মুখের ওপর কীসের স্পর্শ এসে যেন লাগল। পাখির পালকের মতো কিছু একটা আলতোভাবে তার গাল, কপাল, গলা এবং চোখের ওপর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। মুহূর্তে ঘুমটা ভেঙে যায়, ধড়মড় করে উঠে বসে হকচকিয়ে যায় সুবর্ণা। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। তখনও দু’পাটিতে কয়েকটা দাঁত অবশিষ্ট ছিল, সেগুলো বেরিয়ে পড়েছে। হাসির জন্য হনু দু’টো ঠেলে উঠে চোখজোড়া প্রায় বুজে গেছে। সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, তিনিই তার মুখে হাত বুলোচ্ছিলেন।
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এর আগে কখনও নিচে নামেন নি। সুবর্ণা শুনেছে তিনি যাতে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে না যান, সে জন্য সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রাখা হয়। হয়তো পাহারাদারিটা শিথিল ছিল, সেই ফাঁকে একতলায় চলে এসেছেন।
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ মিহি, ভাঙা ভাঙা স্বরে জিজ্ঞেস করছিলেন, কে তুমি? তখনও একটু আধটু কথা বলতে পারতেন তিনি।
বিহ্বলের মতো তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা। বলেছে, আমি—আমি–আমাকে চিনতে পারছেন না?
উত্তর না দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ বলেছেন, আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছ বুঝি?
সুবর্ণা বুঝতে পারছিল, তাকে চিনতে পারেননি শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। বলেছিল, আপনার নাতির সঙ্গে ক’দিন আগে দোতলায় গিয়ে প্রণাম করে এলাম। মনে নেই?
হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিলেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। তার স্মৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য সুবর্ণা বলেছে, আমি আপনার নাতবৌ–
কিন্তু প্রতিক্রিয়া কিছুই হয় নি। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগের মতো হেসে যাচ্ছিলেন।
এই সময় ছুটতে ছুটতে মায়া এসে হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, দেখুন দিকি বৌদিদি, আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম, সেই ফাঁকে কখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছেন। পড়ে গেলে কী সর্বনাশটা যে হয়ে যেত!–চলুন–চলুন ওপরে–হাত ধরে টানতে টানতে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
যদিও বিক্রমের কাছে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছে সুবর্ণা এবং তার নিজের কাছেও লক্ষণগুলো ধরা পড়েছে; তবু পেছন থেকে হঠাৎ কী ভেবে মায়াকে ডেকেছিল সে, শোন–
মায়া ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কিছু বলবেন বৌদিদি?
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে দেখিয়ে সুবর্ণা বলেছে, ওঁর এই অবস্থা হয়েছে কতদিন?
আমি তিন বছর রাজবাড়িতে কাজ করছি। ওঁকে একইরকম দেখছি। শুনেছি আমার আসার অনেক আগে থেকেই নাকি কিছু মনে রাখতে পারেন না।
চিকিৎসা করানো হয়নি?
হয় আবার নি? কলকাতা থেকে বড় বড় ডাক্তার কোবরেজ এনে গুলে খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। দিনকে দিন বরং আরও খারাপ হচ্ছে।
আচ্ছা তুমি যাও।
বিয়ের জন্য একমাস ছুটি কাটিয়ে কলেজে যেতেই কলিগরা সুবর্ণাকে ঘিরে একেবারে হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরাও যথেষ্ট হইচই করেছে, তবে তারা কাছে আসেনি।
কলেজে সুবর্ণার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন হলেন মাধুরী সান্যাল–সবার মাধুরীদি। মধ্যবয়সী মাধুরী ইংরেজির সিনিয়র প্রফেসর। দারুণ আমুদে আর হাসিখুশি। মানুষ হিসেবে চমৎকার। শ্যামবর্ণ, কিন্তু দেখতে ভারি সুশ্রী। এমন কেউ কেউ আছে, সারাজীবন যাদের মধ্যে শৈশবের সারল্য অটুট থাকে। পৃথিবীর কোনও মালিন্য তাদের স্পর্শ করতে পারে না। মাধুরী এদের মধ্যে পড়েন। পঞ্চাশ পেরুলেও তার মুখমণ্ডলে আশ্চর্য এক পবিত্রতা মাখানো। বললেন, এমন একটা রয়াল ম্যারেজ হল। না ধুমধাম, না গ্র্যান্ড ওয়েডিং ফিস্ট। আমাদের একটু জানালে। না পর্যন্ত।
ফিলসফির অধ্যাপক নিরুপম সান্যাল মাধুরীর স্বামী। রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ পড়াতে এসে দু’জনের আলাপ, ভালবাসা এবং বিয়ে। স্ত্রীর স্বভাবের মাধুর্য এবং সারল্যের অনেকটাই তার ভেতরও চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করেছে। এক সঙ্গে জীবন কাটাতে হলে যা হয় আর কি। একজনের ভালমন্দ আরেক জনের মধ্যে ঢুকে যায়।