বিক্রম আগেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, সংগ্রামনারায়ণ তাকে কোনওভাবেই গ্রহণ করতে চাইবেন না। কিন্তু অভ্যর্থনাটা এমন মারাত্মক অপমানজনক হবে, সুবর্ণা ভাবতে পারেনি। তার চোখের সামনে সমস্ত দৃশ্যাবলী ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, পায়ের তলায় নরম কার্পেটে-মোড়া হল-ঘরটা ঢেউয়ের মতো দুলছিল, টলতে টলতে হুড়মুড় করে সে পড়েই যেত, বিক্রম হাত বাড়িয়ে। তার কাঁধটা ধরে ধীরে ধীরে একতলায় নামিয়ে এনেছিল। বিক্রমের স্পর্শের মধ্যে সহানুভূতি ছিল, ভরসা ছিল, ছিল গভীর মমতা।
বিক্রম বলেছিল, ফার্স্ট রাউন্ডটা বাবা জিতে গেলেন। উনি যে এতটা অফেন্সিভ হয়ে উঠবেন, ভাবতে পারিনি। নার্ভাস হয়ো না। আমাদের ম্যারেড লাইফ প্যালেসে সুদ হবে না, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তবে ফাইট এক রাউন্ডেই শেষ হয় না, এটা একটা প্রোট্রাকটেড ওয়ার। আমাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিতে হবে।
সুবর্ণা উত্তর দেয়নি। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে একটা কাজের লোককে দিয়ে তুলো, ডেটল এবং ব্যান্ড-এড আনিয়ে বিক্রমের ফাস্ট-এডের ব্যবস্থা করেছে সে। আর ভেবেছে দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিনটি থেকে যে অসম্মান শুরু হল তা আদৌ শেষ হবে কি না। বিক্রম স্ট্র্যাটেজির কথা বলেছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ক্রোধী, হঠকারী, আত্মম্ভরী একটি মানুষ, যিনি প্রতাপপুর রাজবংশের প্রাচীন গৌরবের মধ্যে যক্ষের মতো বাস করেন, কমোনারদের সম্পর্কে যাঁর প্রবল ঘৃণা তাকে জয় করার মতো পৃথিবীতে কোনও রণকৌশল আছে কি না সুবর্ণার জানা নেই। ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ ভেঙেচুরে যাচ্ছিল।
বিক্রম ফের বলেছে, আসলে রাজত্ব চলে যাওয়াটা বাবা গ্রেসফুলি মেনে নিতে পারেননি। যেদিন রাজতন্ত্র অ্যাবলিশড হল সেদিন থেকে তিনি খেপে আছেন। তার বিশ্বাস আমাদের সর্বস্ব গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সবার ওপর, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির ওপর তার প্রচণ্ড রাগ। ক্রোধ ছাড়া তার মধ্যে আর কোনও ফিলিংই নেই। নাথিং লেফট একসেপ্ট ভায়োলেন্ট অ্যাঙ্গার। এত কাল ওঁর রাগের ধাক্কাটা বাড়ির সবাই সামলেছে। এখন থেকে তুমি হলে নতুন টার্গেট।
সুবর্ণা চুপ করে থেকেছে।
জুতোর বাড়িতে নাক ফেটে গেলেও সংগ্রামনারায়ণের প্রতি বিক্রমের মনোভাব ছিল সহানুভূতিশীল। বাবার আচরণ সম্পর্কে সে যা বলেছে তা মোটামুটি যুক্তিপূর্ণ। দেড়শ বছরের এক প্রাচীন রাজ-পরিবারের প্রতিপত্তি, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়াটা তার বংশধরদের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষোভের ব্যাপার। অবিরল সেই ক্ষোভ থেকে সংগ্রামনারায়ণের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেকে সর্বক্ষণ তিনি একটা আগ্নেয়গিরি বানিয়ে রেখেছেন।
বিক্রম থামেনি, জঙ্গল থেকে বাঘ ধরে এনে ট্রেনিং দিয়ে বশ করা হয়, সেটা নিশ্চয়ই জানো?
প্রশ্নটার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ধরতে পারেনি সুবর্ণা। বিহ্বলের মতো জিজ্ঞেস করেছে, হাঁ জানি, কিন্তু হঠাৎ একথা?’
সিলিংয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মজার গলায় বিক্রম বলেছে, ওপরে যে ব্যাঘ্রটি আছেন তাকে বাগে আনার ওপর আমাদের ম্যারেড লাইফের পিস, হ্যাপিনেস অনেকটা নির্ভর করছে। টাইগার ট্রেনারের রোলটা নিতে পারবে কি? বাবা তোমাকে যেভাবে ইনসাল্ট করেছে তার একটা জবাব দেওয়া তো দরকার।
সংগ্রামনারায়ণ সম্পর্কে রণকৌশলের কথা বলেছে বিক্রম, বাঘ বশ করার দৃষ্টান্ত দিয়েছে, কিন্তু এসব কিছুই মাথায় ঢুকছিল না সুবর্ণার। সে শুধু ভেবেছিল, এখন থেকে সংগ্রামনারায়ণের সঙ্গে এক বাড়িতে তাকে থাকতে হবে। দোতলায় যাতে না যায় সে জন্য তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কোনওদিন ওপরে যাবেও না সুবর্ণা। কিন্তু সংগ্রামনারায়ণ তো নিচে নেমে আসতে পারেন। কখন যে তিনি কী করে বসবেন তাই বা কে জানে। ভয়ে, আশঙ্কায় সে সিটিয়ে গিয়েছিল।
বিয়ের সময় কলেজ থেকে একমাস ছুটি নিয়েছিল সুবর্ণা। আগেই বিক্রমের কাছে জেনেছে, এ বাড়িটা পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক। তার শাশুড়ি এবং দিদিশাশুড়ি কেউ জীবিত নেই, অনেকদিন আগে মারা গেছেন। বিক্রমের পিসিমার যখন বিয়ে হয় তখন ওর জন্মই হয়নি। ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর সমস্ত কিছু কাজের লোকেরাই চালায়। রাজবাড়ির বৌ হিসেবে সংসারের দায়িত্ব সে নিজের হাতে তুলে নেবে তেমন দুঃসাহস সুবর্ণার হয়নি। নিজেকে সে একতলাতেই গুটিয়ে রেখেছিল। মায়া আর হরেন তখনও এ বাড়িতে কাজ করত। সকাল, দুপুর এবং রাত্তিরে ওপর থেকে খাবার এনে তাকে খাইয়ে যেত মায়া। সুবর্ণার মনে হত সে যেন শ্বশুরবাড়িতে নয়, কোনও একটা হোটেলে এসে উঠেছে। সংগ্রামনারায়ণের সেদিনের নিষ্ঠুর ব্যবহারে নিজেকে এখানে অবাঞ্ছিত মনে হল সুবর্ণার। তবে কাজের লোকেদের, বিশেষ করে হরেন আর মায়ার সহানুভূতি প্রথম থেকেই পেয়েছিল।
রাজবংশের ছেলের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের বিয়ের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নানাভাবে–প্যালেসের ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও। খবরটা জানাজানি হওয়ার পর উদয়পুর স্টেট থেকে বিক্রমের পিসিমা সংগ্রামনারায়ণকে কড়া চিঠি লিখেছিলেন। দেশের পুরনো দেশীয় রাজ্যগুলোতে যেসব আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে রয়েছেন, চিঠি লিখে বা ফোন করে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। সবারই বক্তব্য, এই বিয়েটা প্রতাপপুর রাজ-পরিবারকে কলঙ্কিত করেছে, তার মর্যাদা রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। এ বিয়ে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া উচিত হয় নি সংগ্রামনারায়ণদের।