কী?
এবার বিক্রম যা উত্তর দিয়েছিল তা এইরকম। তার বাবার বিয়ে হয়েছিল সাউথ বেঙ্গলের এক রাজবাড়িতে। ঠাকুরদা বিয়ে করেছিলেন মধ্যপ্রদেশের এক নেটিভ স্টেটের প্রিন্সেসকে। একমাত্র পিসিমার বিয়ে হয় উদয়পুর স্টেটে। ঠাকুরদার বাবা কি তার বাবা আর ঠাকুরদাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া হল। কারণ প্রতাপপুর স্টেটের তখন বিপুল অর্থ, প্রচণ্ড প্রতাপ এবং দেশ জুড়ে খ্যাতি। অন্য দেশীয় রাজ্যগুলো এই বংশের ছেলেমেয়েদের জামাতা বা বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। ফলে পূর্বপুরুষদের যে সব বিয়ে হয়েছে তার জাঁকজমক শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়। ঠাকুরদার আমলে কিংবা তার পরে কিছুকাল রাজতন্ত্র চালু থাকলেও নানা কারণে রাজবংশের গৌরব অনেকটাই পড়তির দিকে। তবু তার বাবা এবং পিসির বিয়েতে দশ মণ করে বাজি পুড়েছিল। ইন্ডিয়ার নাইনটি পারসেন্ট নেটিভ স্টেটের রাজা বা প্রিন্সরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। আর । এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল, হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস, আর্মি কমান্ডার, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট থেকে দেশের বিখ্যাত সব পার্সোনালিটি। কলকাতা থেকে নাম করা সানাইওয়ালারা আর দশটা মিলিটারি ব্যান্ডপার্টি এসে। দু’সপ্তাহ ধরে বাজিয়ে গিয়েছিল। স্টেটের কোনও বাড়িতে সাতদিন রান্না চড়েনি। সমস্ত প্রজা রাজবাড়িতে ভোজ খেয়েছে। প্রতাপপুর সিটি ফেরারি টেলসের কোনও শহরের মতো অজস্র রং আর আলোয় সেজে উঠেছিল। গেস্টদের হাতির পিঠে রুপোর ছত্রির তলায় বসিয়ে চারিদিকে ঘোরানো হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ লেকের ওধারের জঙ্গলে শিকার খেলতে গিয়েছিলেন।
বিক্রম একটানা বলে যাচ্ছিল, আলো, সানাই, ব্যান্ডপার্টি, হাতি, ঘোড়া, রোলস রয়েস গাড়ির মিছিল, শিকার, হীরে, মুক্তো, পান্না, সোনার মোহর, দামী দামী পোশাক, প্যালেস জুড়ে বিলিতি পারফিউমের সুগন্ধ আর সারাদিন ভোজ সব মিলিয়ে সেই গ্র্যাঞ্জার সেই পেজেন্ট্রি তুমি ভাবতেও পারবে না। কিন্তু—
নিঃশ্বাস বন্ধ করে যেন অলীক এক রূপকথার গল্প শুনে যাচ্ছিল সুবর্ণা। এবার জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু কী?
বিক্রম বলেছে, আমাদের বিয়েতে এসব কিছুই হবে না। রাজত্ব টাজত্ব চলে যাবার পর অত খরচ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। যেটুকু আছে, তোমাকে বিয়ে করলে বাবা একটা পয়সা তো বার করবেনই না, বরং যতভাবে বাধা দেওয়া সম্ভব দেবেন। আড়াইশো টাকা খরচ করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে কাজটা চুকিয়ে ফেলতে হবে।
এমন সাদামাঠা, গোপন বিয়েতে মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না সুবর্ণার।. একটু তরুণীর জীবনে বিয়েকে ঘিরে অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু তার কতটুকুই বা পূরণ হবে? মনে হচ্ছিল, নিঃশব্দে চুরি করে সে কিছু একটা পেতে চলেছে। কিন্তু বিক্রমকে নিয়ে সুবর্ণা এমনই আচ্ছন্ন যে এসব তাকে বলা যায়নি। শুধু ঝাপসা গলায় জিজ্ঞেস করেছে, ঠিক আছে, তুমি যা বললে তাই হবে। কিন্তু বিয়ের পর আমরা কোথায় থাকব?’
কোথায় আবার, আমাদের বাড়িতে।
কিন্তু তোমার বাবা?
সুবর্ণার দ্বিধা বা ভীতিটা কী কারণে সেটা বুঝতে পারছিল বিক্রম। তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলেছিল, যুদ্ধটা কি আমার একার? আমাদের বংশের ট্র্যাডিশনটা আমার সঙ্গে তুমিও তো ভাঙছ। বিয়ে যখন হচ্ছেই, লিগালি তুমি প্রতাপপুর রয়াল ফ্যামিলির বৌ হবে। ইউ মাস্ট এস্টাব্লিশ ইওর রাইটস। কী, পারবে না?
বিক্ৰম কথা বলত চমৎকার। একেবারে মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো। একজন। কমোনারকে রাজবাড়িতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সুবর্ণার কাছে হঠাৎ এটা দারুণ উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হয়েছিল। ভয়টা খানিক কাটিয়ে সে বলেছিল, চেষ্টা করব।
দ্যাট শুড বি দা স্পিরিট।
বিয়ের ব্যাপারে শিলিগুড়িতে গিয়ে মা, বাবা এবং দাদার সঙ্গে কথা বলেছিল সুবর্ণা। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে আর রাজবংশের একটি ছেলে–পার্থক্যটা এত বিশাল যে সে সুখী হতে পারবে কি না, কিংবা তার। বিবাহিত জীবন শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে কি না–এ নিয়ে বাড়ির সবার ভীষণ। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল উন্মাদনার বশে বিয়ের এই সিদ্ধান্তটা খুবই হঠকারী। তারপর যখন শুনলেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে চুপচাপ বিয়েটা। সারতে হবে তখন মা-বাবা আর দাদার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
অবশ্য মা-বাবা চিরদিনই যথেষ্ট লিবারাল। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তারা সুশিক্ষিত। সন্তানদের ওপর নিজেদের মতামত, পছন্দ-অপছন্দ বা ইচ্ছা অনিচ্ছা কখনও চাপিয়ে দেননি। শুধু শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো পরামর্শ দিয়েছিলেন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে যাবার আগে সমস্ত দিক যেন ভাল করে ভেবে নেয় সুবর্ণা।
বাড়ির সবার প্রচণ্ড সংশয় আর দুর্ভাবনা থাকলেও বিয়েটা কিন্তু হয়ে গিয়েছিল। ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে বিক্রমের সঙ্গে সোজা ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে গেছে সুবর্ণা। দোতলায় উঠে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে তারা প্রথমে প্রণাম করেছিল। তখন তাঁর স্মৃতি নষ্ট হতে শুরু করেছে। বিমূঢ়ের মতো তিনি তাকিয়ে ছিলেন শুধু। প্রণামের কারণটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
সংগ্রামনারায়াণ কিন্তু প্রণাম করতে দেননি। বিয়ের কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখচোখ অসহ্য ক্রোধে লাল হয়ে উঠেছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শরীরের সব রক্ত যেন সেখানে গিয়ে জমা হয়েছে। মনে হচ্ছিল তিনি ফেটে পড়বেন, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সিঁড়ির দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণাকে বলেছিলেন, নিচে নেমে যাও কক্ষণো দোতলায় উঠবে না। বিক্রমকে বলেছেন, শুয়ার, স্কাউড্রেল, রাস্তার একটা মেয়েকে ধরে এনে রাজবংশের এক গালে চুন, আরেক গালে কালি লাগালি? গেট আউট অফ মাই সাইট।’ বলে পা থেকে শুড়-তোলা এক পাটি চটি খুলে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। সেটা সোজা বিক্রমের নাকে লেগে দরদর করে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল।