সুবৰ্ণারা দুই ভাইবোন। দাদা গৌতম অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কিং সারভিসের পরীক্ষা দিয়ে একটা নাম-করা শিডিউল্ড ব্যাঙ্কে ঢুকেছিল। পোমোশন পেয়ে পেয়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়েছে। আপাতত আছে দিল্লিতে। আর সে নিজে হিস্ট্রিতে ভাল রেজাল্ট করে প্রতাপপুরের রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এর লেকচারার হয়ে এসেছিল পনের বছর আগে। থাকত কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের জন্য নির্দিষ্ট হস্টেলে। সে এই শহরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পড়ানোর এবং সৌন্দর্যের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও রাজতন্ত্র আর নেই, গভর্নমেন্টের শিক্ষা বিভাগ ফি বছর বিরাট অঙ্কের গ্রান্ট দেয়, তবু প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রানী স্বর্ণময়ী কলেজ’-এ রাজবংশের মর্যাদা অপরিসীম। তাছাড়া কলেজের নামে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের বাবা অর্থাৎ বিক্রমের প্রপিতামহ রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণ পঁচিশ লক্ষ টাকার একটা ফান্ড করে গিয়েছিলেন। সেই টাকার ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট থেকে কলেজের যাবতীয় খরচের অনেকটাই উঠে আসে।
নেটিভ স্টেটগুলো ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে মিশে যাবার সময় ঠিক হয়েছিল রাজবংশের কেউ একজন সব সময়ই কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হবেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার রাজপরিবারের সঙ্গে এই চুক্তিটিকে কখনও অমর্যাদা করেনি। সুবর্ণা যখন লেকচারশিপ নিয়ে আসে, বিক্রম ছিল চেয়ারম্যান।
স্বাভাবিক কারণেই সুবর্ণার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিক্রমের। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় গুঁজে পড়েছিল সে। যখন তখন হস্টেলে চলে আসত। সুবর্ণাকে তার টু-সিটার স্পোর্টস-কারে তুলে নিয়ে শহর থেকে হাইওয়ের দিকে চলে যেত। কোনওদিন বা পঞ্চাশ মাইল দূরে পাহাড়ের গায়ে ছবির মতো একটা লেকের ধারে, যেটা চমৎকার টুরিস্ট স্পট। ছোট্ট মোটরবোটে দুরন্ত স্পিড তুলে লেকের জল তোলপাড় করে তারা যেন উড়তে থাকত।
আভাসে ইঙ্গিতে কলিগদের কেউ কেউ বিক্রম সম্পর্কে সুবর্ণাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু বিক্রম দুশ্চরিত্র, লম্পট, প্লে-বয় টাইপের ছেলে–এসব সতর্কবার্তা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। তখন সবে তেইশে পা দিয়েছে সুবর্ণা। একজন সত্যিকারের সুপুরুষ তরুণ রাজপুত্র তার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে, এটা তার যুবতী হৃদয়ের অহংকারকে যেন শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। অল্প বয়সে প্রিন্স অ্যান্ড আ স্ট্রিট গার্ল’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিল সে, কিংবা ওই নামের বইও পড়ে থাকতে পারে। সেখানে এক রাজকুমার পথের এক গরিব অনাথ মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। এও তেমনই এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। সে রাস্তার মেয়ে নয়, সাধারণ মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে তার জন্ম। একেবারেই কমোনার-অনভিজাত। তার বেলায় কাহিনীর নামটা একটু বদলে দেওয়া যেতে পারে–প্রিন্স অ্যান্ড আ কমন গার্ল। একটি কৌলিন্যহীন, অখ্যাত মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ের পক্ষে একজন রাজপুত্রকে জয় করে নেওয়ার মধ্যে প্রচণ্ড উন্মাদনা থাকে। ব্যাপারটা প্রায় রূপকথার মতো। সুবর্ণা যেন রঙিন বাতাসে স্বপ্নের ঘঘারে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
পরিচয়ের একমাসের মাথায় বিক্রম বলেছিল, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না সুবর্ণা। আমি একটা ডিসিসান নিয়ে ফেলেছি।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করেছিল, কীসের ডিসিসান?’
এক উইকের ভেতর আমরা বিয়ে করছি। তবে
তবে কী?
আমার বাবাকে তা জানানো যাবে না। তুমি অবশ্য তোমাদের বাড়িতে জানাতে পারো।
সুবর্ণা চমকে উঠেছিল, তোমার বাবাকে জানানো যাবে না কেন?
বিক্রম জানিয়েছে, দেড়শ বছরের ইতিহাসে তাদের বংশের ছেলেমেয়েদের ভারতবর্ষের অন্য রাজপরিবারে ছাড়া আর কোথাও বিয়ে হয়নি। সুবর্ণাকে সে বিয়ে করলে সেটা হবে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর পক্ষে পৃথিবীকে রসাতলে পাঠানোর মতো একটা দুর্ঘটনা। দেড়শ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে যে রক্তধারা বয়ে চলেছে তা বিশুদ্ধ থাকুক, সেদিকে তার বাবা সংগ্রাম নারায়ণের তীক্ষ্ণ নজর। রাজত্ব নেই, রাজতন্ত্র নেই, তবু আত্মম্ভরিতাকে যখের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। তুচ্ছ, হেজিপেজি ঘরের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করে প্রতাপপুর রাজ-পরিবারের বংশধরেরা নিষ্কলঙ্ক রাজরক্তের সঙ্গে কমোনারের রক্ত মিশিয়ে দূষিত করে ফেলুক সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। পুত্রবধূ হিসেবে সুবর্ণাকে মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
শুনতে শুনতে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। এস্ত ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞেস করেছে, তা হলে?
বিক্রম হেসেছে, বাবা মেনে নেবেন না বলে আমি পিছিয়ে যাব? রয়ালটি নেই। ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসিতে মুদি, মাছওলা, সুইপারের ভোটের যা দাম, আমাদেরও তাই। এক্স রাজা-মহারাজাদের জন্যে স্পেশাল কোনও খাতিরের ব্যবস্থা নেই কনস্টিটিউশনে। রাজা টাজা আর কমোনাররা একদিন একাকার হয়ে যাবে। আমাদের বংশে সেই প্রসেসটা আমিই শুরু করব তোমাকে বিয়ে করে। এটা একরকম রেভোলিউশনই বলতে পার। প্রতাপপুর রয়াল ফ্যামিলিতে আমিই প্রথম রেবেল।
সুবর্ণা জানতে চেয়েছে, তোমার বাবা মেনে না নিলে বিয়েটা হবে কী করে?
গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাডাল্ট ইয়াং ম্যান আর ইয়াং গার্লদের জন্যে প্রচুর সুবিধা করে দিয়েছে। ইনডিপেনডেন্সের পর এই প্রতাপপুর সিটিতে মিনিমাম এক ডজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিস হয়েছে। এখন বিয়ে করাটা কি কোনও প্রবলেম? তবে–