রাজবাড়ি, বাগান, দীঘি ইত্যাদি ঘিরে যে কম্পাউন্ড ওয়াল, নানা জায়গায় সেটা ভেঙেচুরে গেছে। রাস্তার দিকে মোটা গরাদওলা যে জমকালো লোহার গেটটা ছিল, রোদে জলে মরচে ধরে সেটার আয়ু প্রায় শেষ। গরাদগুলোর বেশ কয়েকটাই উধাও হয়ে গেছে। যেভাবে গেটটা হেলে আছে, যে কোনওদিন হুড়মুড় করে ঘাড় খুঁজে পড়ে যাবে।
আকাশের গায়ে যে ফ্যাকাসে আলোটুকু আটকে ছিল, চোখের পলকে কেউ যেন অদৃশ্য একটা ব্রাশ টেনে সেটা মুছে দিল। এই জায়গাটা এমনই, নভেম্বর মাসে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার আর কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
ঠিক এই সময় ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এর দোতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিল সুবর্ণা আর দেবী। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই সিঁড়ি আধখানা বৃত্তের আকারে একতলার বিশাল হলঘরের ঠিক মাঝখান থেকে দোতলা হয়ে ছাদের দিকে চলে গেছে। এক সময় সিঁড়ি এবং হল-ঘর দামি কাশ্মিরি কার্পেট দিয়ে মোড়া ছিল। সিঁড়ির কার্পেট পায়ের ঘষায় কবেই উঠে গেছে, তার একটি সুতোও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। হলের কার্পেটটাও ছিঁড়ে খুঁড়ে বেশির ভাগটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু একধারে খানিকটা অংশ কোনওরকমে টিকে আছে। এক সময় ওটার রং ছিল টকটকে লাল, এখন শুকনো রক্তের মতো কালো, তার ওপর ইঞ্চিখানেক পুরু ধুলো।
হলঘরে সাবেক কালের ভারী ভারী আসবাব–সোফা, ডিভান, চেয়ার, পিয়ানো, আলমারি ইত্যাদি। সবই দামি মেহগনি কাঠের, কিন্তু কোনওটাই আস্ত নেই। পালিশও বহুকাল আগে নষ্ট হয়ে গেছে। রং-চটা, বিবর্ণ দেওয়ালগুলোতে রাজবংশের নানা প্রজন্মের কয়েকজনের বিরাট বিরাট অয়েল পেন্টিং। সিলিং থেকে যে প্রকাণ্ড ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে তার অগুনতি কাঁচের দীপাধারের মাত্র কয়েকটাই টিকে আছে। বাকিগুলো অনেক দিন আগে কখন ভেঙে পড়েছে, কেউ লক্ষ রাখেনি। ঝাড়লণ্ঠনটা এখন আর জ্বলে না। আলোর জন্য এধানের ওধারে ক’টা টিউব লাইট লাগানো হয়েছে। সেগুলো এই মুহূর্তে জ্বলছে, তবে বিশাল হলঘরটাকে পুরোপুরি আলোকিত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। টিউব লাইটগুলো থেকে দূরে হলের কোণে কোণে আবছা অন্ধকার।
এবার সুবর্ণা আর দেবীর দিকে তাকানো যেতে পারে। সুবর্ণার বয়স সাঁইত্রিশ আটত্রিশ। লম্বা, টানটান চেহারা। গায়ের রং এক সময় ছিল রৌদ্রঝলকের মতো, এখন তার ওপর পাতলা, কালচে সরের মতো কিছু পড়েছে। ডিম্বাকৃতি মুখ। চিবুকের গঠনটি দৃঢ়, ঠোঁট ঈষৎ পুরু। বড় বড় চোখের দৃষ্টি শান্ত, কিন্তু দুরভেদী। চমৎকার স্বাস্থ্য তার। সুবর্ণার দিকে এক পলক তাকালেই টের পাওয়া যায়, সে প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এবং কোনওরকম বেচাল করে এর কাছে পার পাওয়া যাবে না।
সুবর্ণার পরনে হালকা রঙের কোটা শাড়ি আর বাদামি ব্লাউজের ওপর গরম পশমি চাদর জড়ানো, পায়ে পাতলা স্লিপার। বাঁ হাতের কবজিতে সরু ফিতেয় বাঁধা সুদৃশ্য ঘড়ি, ডান হাতে একটি মাত্র মোটা রুলি, গলায় লকেটওলা সোনার চেন।
দেবীর বয়স এগারো। সে সুবর্ণার একমাত্র মেয়ে। মায়ের পুরো আদলটি দেবীর চেহারায় বসানো। তেমনই চোখমুখ, নাক বা চিবুক। তার পরনে স্কার্ট আর ফুলহাতা জামার ওপর উলের পুলওভার। চুল হেয়ার-ব্যান্ড দিয়ে আটকানো, পায়ে মায়ের মতোই ঘরে পরার স্লিপার। তার হাতে বইভর্তি একটা ব্যাগ।
হলঘরের একধারে দশ ফুট উঁচু, ছ ফুট চওড়া নকশা-করা দরজা, যার মাথার দিকটা গোলাকার। দরজার কারুকাজ এখন আর বোঝা যায় না। বছরের পর বছর রোদে পুড়ে, জলে ভিজে এবং ধুলোময়লা জমে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।
রোজই এই সময় দরজাটা ভেজানো থাকে। হলের টিউব লাইটগুলো জ্বালিয়ে বাইরে থেকে পাল্লা দু’টো টেনে দিয়ে যায় হরেন। কেননা এই সন্ধেবেলায় দেবীর প্রাইভেট টিউটর পড়াতে আসেন। হলের ঠিক মাঝখানে ঝাড়লণ্ঠনের তলায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে চেয়ার-টেবিল পেতে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আজ কিন্তু দেখা গেল দরজাটা পুরোপুরি ভেজানো নেই, তার একটা পাল্লা খোলা। খুব সম্ভব হাওয়ায় খুলে গেছে। খোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে দূরে শহরের একটা দিক চোখে পড়ে। সেখানে আলো জ্বলছে। কুয়াশা এবং অন্ধকারে আলোগুলো রহস্যময় সংকেতের মতো মনে হয়।
‘প্রতাপপুর প্যালেস’ শহর থেকে খানিকটা দূরে। সামনের দিকের গেটের পর অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, তারপর শহরের ঘরবাড়ি শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষজনের কাছ থেকে দূরত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য রাজবাড়িটা এভাবে তৈরি করা হয়েছিল। রাজা-রাজড়ারা যে রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের থেকে আলাদা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়াটাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। আশ্চর্যের ব্যাপার, জনগণতন্ত্র চালু হওয়ার পরও মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। জবর দখল করে কেউ ওখানে কলোনি টলোনি বসায়নি। সারা দেশ জুড়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ডেমোক্রেসির হাওয়া বয়ে গেলেও মানুষের মনে রাজা মহারাজাদের সম্পর্কে খানিকটা সম্ভ্রম এখনও থেকে গেছে। হয়তো এটা সহজাত সংস্কার, মানুষের রক্তের মধ্যে আবহমানকাল অদৃশ্য শিকড়ের মতো ছড়িয়ে আছে। সেটা কাটিয়ে উঠতে আরও একশ বছর লেগে যাবে কিনা, কে জানে।