আচ্ছা–
মায়া চলে যেতেই শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে খাওয়ানোর তোড়জোড় শুরু করে সুবর্ণা। গরম দুধে খই ঢালতেই সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে যায়। তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে চামচে করে মুখে দিতে থাকে সে।
এই বয়সে, বিশেষ করে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের মতো মানুষের ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধটাই মরে যায়। অন্যমনস্কর মতো মুখের ভেতর খই দুধ নাড়াচাড়া করতে । থাকেন তিনি। অবিকল বাচ্চাদের মতো। খানিকটা পেটে যায়, খানিকটা কষ বেয়ে। গড়িয়ে পড়ে। নরম পাকের পুরো একটা সন্দেশও খাওয়ানো যায় না, অর্ধেকের বেশিটাই পড়ে থাকে।
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়ার পালা চুকতে আধ ঘণ্টা লেগে যায়। তারপর তাকে শুইয়ে, খাটের মশারি ফেলে, চারপাশে গুঁজে দিয়ে সুবর্ণা বলে, দাদাভাই ঘুমিয়ে পড়ুন।
এদিকে ডিভানে বিছানা পেতে মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মায়া। রাজীবের দিকে ফিরে সুবর্ণা বলে, আমি এবার যাব। ইচ্ছা করলে আপনি শুয়ে পড়তে পারেন।
রাজীব বলে, হ্যাঁ, শুয়েই পড়ব। ঘুম পাচ্ছে।
কী ভেবে সুবর্ণা বলে, দরজা ভেতর থেকে নিশ্চয়ই বন্ধ করে দেবেন?
রাজীব বলে, তা তো দিতেই হবে। আমার সেফটির ব্যাপার আছে না?
তার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল সুবর্ণা। দরজা খুলে ঘুমিয়ে পড়লে সে লোজন ডাকতে পারে, পুলিশকে খবর দিতে পারে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তার চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্য ভোলে না রাজীব। সুবর্ণা একটু হেসে বলে, আমি কিন্তু আপনার কথা ভাবিনি। দাদাভাই রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়লে আমরা বাইরে থেকে দরজার শেকল তুলে দিই। তবু নজর রাখতে হয়। কেননা হঠাৎ হঠাৎ উঠে ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ানো ওঁর অভ্যাস।
নাইট ওয়াকার?
হ্যাঁ। একবার শেকল লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। নেহাত সেই সময় আমার ঘুমটা ভেঙে যায়, নইলে সর্বনাশ হয়ে যেত।
আপনি কি রোজ রাত্তিরে উঠে উঠে ওল্ড ম্যানটিকে দেখে যান?
তা তো দেখতেই হয়। আমি একটু কষ্ট করলে একটা মানুষ যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে, সেটা করব না?’ বলে বেরিয়ে যায় সুবর্ণা।
অবাক রাজীব ধীরে ধীরে উঠে দরজায় ছিটকিনি এবং খিল, দু’টোই লাগিয়ে দেয়।
.
০৭.
নিজের ঘরে এসে ঘণ্টাদেড়েক ধরে দেবীর কালকের স্কুলের পড়াগুলো করিয়ে দেয় সুবর্ণা। কাল তার নিজেরও অনার্সের দু’টো ক্লাস আছে। দেবীকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কিছু রেফারেন্সের বই দেখে নেয় সে। ভাল পড়ায়, ভাল নোট দেয়। তাই তার কাছে ছাত্রছাত্রীদের দাবি অনেক। তাদের প্রত্যাশা কখনও অপূর্ণ রাখে না সুবর্ণা।
পড়াটড়া হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি খাওয়ার পালা চুকিয়ে শুয়ে পড়েছিল তারা। মস্ত খাটে সে আর দেবী পাশাপাশি শোয়। তাদের লেপ আলাদা। কাউকে জড়িয়ে। ধরে ঘুমোতে অস্বস্তি হয় দেবীর। আজ কিন্তু তার লেপের ভেতর ঢুকে মাকে আঁকড়ে ধরে, গায়ের সঙ্গে লেপটে শুয়েছে মেয়েটা। ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে। কেঁপে উঠছে। কারণটা অনুমান করতে পারছিল সুবর্ণা। রাজীবের জন্য তার সুস্থ, স্বাভাবিক মেয়েটা ফিয়ার সাইকোসিস অর্থাৎ ভয়ে মানসিক রোগের শিকার না হয়ে পড়ে। দেবী তার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। স্বামী বিক্রমের সঙ্গে সুবর্ণার আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। সে এ বাড়ি ছেড়ে দশ বছর আগে চলে গেছে, কোনওদিনই আর ফিরবে না। দাম্পত্যজীবন মেয়েদের কাছে বুঝিবা সবচেয়ে মূল্যবান ঐশ্বর্য। সেদিক থেকে সুবর্ণা একেবারে নিঃস্ব। বিক্রমের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর সেই শূন্যতার বেশির ভাগটাই ভরাট করে দিয়েছে দেবী। কলেজে তার একটা ভাল চাকরি আছে, থাকার জন্য বিশাল প্রাসাদ আছে, আছে অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী, বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কিন্তু এসব দিয়ে কি দাম্পত্য জীবনের রিক্ততা পূরণ হয়? ভেতরে ভেতরে কবেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে সে শেষ হয়ে যেত। হয় যে নি, তার কারণ দেবী। মেয়েটা নিজের অজান্তে অবিরল তার বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়ে চলেছে। সে সুবর্ণার আশ্রয়, অবলম্বন। শ্বাসবায়ুর মতো অপরিহার্য। রাজীবের জন্য দেবীর যদি কিছু হয়ে যায় সে বাঁচবে না।
আজ সন্ধের পর থেকে কয়েকটা ঘণ্টা এ বাড়িতে যে সব ভীতিকর, চমকপ্রদ আর দমবন্ধ করা ঘটনা ঘটে গেল তার চাপে স্নায়ুগুলো টান টান হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণার। এখন, বিছানায় দামী লেপের আরামদায়ক উষ্ণতার ভেতর শরীর ঢেলে দেবার পর সেগুলো শিথিল হয়ে আছে। একটানা দীর্ঘ সময় উত্তেজনা এবং আতঙ্কের অসহনীয় চাপ আজকের মতো খানিকটা কেটে গেলেও ঘুম আসছে না। বার বার রাজীবের চিন্তাটা ঘুরে ঘুরে তার মস্তিষ্কে হানা দিতে থাকে। সেই সঙ্গে কোনও কার্যকারণ ছাড়া হঠাৎ অদৃশ্য মঞ্চের পর্দা সরে গিয়ে তার নিজের জীবনের নানা দৃশ্য ফুটে উঠতে লাগল। অলৌকিক নাটকের মতো। অলৌকিক হয়েও কিন্তু রিয়াল।
রাজীবের মতো সেও ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চোদ্দ বছর আগে ঢুকে পড়েছিল। তবে ওর মতো গায়ের জোরে, আতঙ্কের একটা পরিবেশ তৈরি করে নয়। সে এখানে এসেছিল ভয়ে ভয়ে, সসঙ্কোচে, বিক্রমের পেছনে পেছনে রুদ্ধশ্বাসে।
.
সুবর্ণাদের বাড়ি শিলিগুড়িতে। বাবা ছিলেন পি ডর ডি’র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আই. এ পাশ মা নেহাতই হাউসওয়াইফ, ঘর-সংসারে আবদ্ধ আর দশজন মহিলার মতো আদ্যোপান্ত সুগৃহিণী।