সুবর্ণা বেরিয়ে যাচ্ছিল, জড়ানো গলায় সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার সেই আত্মীয়টির থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছ তো?
ওষুধের ঘোরের মধ্যেও তার মস্তিষ্ক পুরোমাত্রায় সক্রিয়। দু’টো স্ট্রোক সংগ্রামনারায়ণকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। তবু মাথাটা তার পরিষ্কার, কিছুই ভোলেন না। এমন কি কড়া ওষুধের কারণে এখন এই আচ্ছন্নতার মধ্যেও রাজীবের কথা তার মনে আছে। সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ, বাবাঘর থেকে বেরিয়ে সে সোজা কিচেনের দিকে চলে গেল। লক্ষ করল, রাজীব হল-ঘরে নেই। খাওয়া শেষ করে কখন যেন শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে গেছে।
রান্নাঘরে পা দিতেই হাতের ইশারায় সুবর্ণাকে তার কাছে যেতে বলল মায়া।
সুবর্ণা ক’পা এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
মায়া চুপচাপ বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে চাপা, ভয়ার্ত গলায় বলল, এ আপনি কাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে এসেছেন বৌদিদি?
একটু চমকে ওঠে সুবর্ণা। বলে, কেন, কী হয়েছে?
লোকটা ভাল নয়।
কী করে বুঝলে?
চেহারাটা ডাকাতদের মতো। মায়ার চোখে চোখ রেখে সুবর্ণা বলে, চেহারা দেখে কি সবসময় ভালমন্দ বোঝা যায়?
মায়া বলল, শুধু চেহারাই না–’
তাহলে?
ওর কাছে একটা পিস্তল আছে।
সুবর্ণার খানিক আগের চমকটা এবার বদলে গিয়ে দ্রুত মাথার ভেতর প্রবল দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করে। রাজীবের সঙ্গে যে মারণাস্ত্র রয়েছে সেটা দেবী আর সে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে। বাড়ির অন্য কেউ, বিশেষ করে কাজের লোকেরা জানুক, তা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। ঘাবড়ে গিয়ে তারা কিছু করে বসলে গোটা পরিবারের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্ভাবনা।
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, পিস্তল যে আছে, তুমি জানলে কী করে?
আপনি যখন দারোগাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন ওই লোকটা খাওয়া ফেলে সিঁড়ির পাশের মোটা থামটার আড়ালে গিয়ে পিস্তল বের করে দাঁড়িয়ে ছিল।
এ বাড়ির কাজের লোকেরা কোনও ব্যাপারেই কৌতূহল প্রকাশ করে না। কিন্তু রাজীবকে দেখার পর থেকেই মায়া তার সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হয়ে আছে। সুবর্ণা ভাবল, সে যখন নিচে ওসি’র সঙ্গে কথা বলছে, মায়া ওর ওপর নিশ্চয়ই লক্ষ রাখছিল। বলল, কোনও ভয় নেই। যেমন কাজ করছিলে করে যাও। শুধু ওর সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলবে না।
মায়ার গলার কাছ’টা উৎকণ্ঠায় ভীষণ কাঁপছিল। বলল, আমাদের বিপদ হবে না তো?
ঠিক এই প্রশ্নটা দেবীও করেছিল। ভঙ্গুর একটু হেসে সুবর্ণা মায়ার ভীতিটা উড়িয়ে দেবার সুরে বলল, না না, কীসের বিপদ। বলল বটে, মনে মনে সে কিন্তু জানে তার এই ভরসা দেওয়াটা কতখানি দুর্বল আর অর্থহীন।
মায়া তবু কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে সুবর্ণা ফের বলে, আমি দাদাভাইয়ের ঘরে যাচ্ছি। তুমি ওঁর রাতের খাবারটা নিয়ে এস। ওই সঙ্গে এক ডেকচি গরম জল আর তোয়ালে। বলেই চলে যায়।
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে একটা সোফায় কাত হয়ে বসে ছিল রাজীব। দু’দিন পর স্নান করে, প্রচুর পরিমাণে ভাত মাংস টাংস খেয়ে ক্লান্তি অনেকখানি কেটে গিয়েছিল তার। পেটে ভাত পড়লে যা হয়, চোখে ঢুল আসছিল কিন্তু নিজেকে। ঘুমিয়ে পড়তে দিচ্ছিল না সে। রাত্রিবেলা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত তার পক্ষে ঘুমনো সম্ভব নয়। চোখ মেলে রেখে অন্যমনস্কর মতো সে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে লক্ষ করছিল।
সেই আগের মতোই ডিভানে বসে বিহ্বলের মতো তাকিয়ে আছে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ। মুখে সেইরকমই শব্দহীন, অবোধ হাসি।
সুবর্ণা ঘরে ঢুকতেই সোজা হয়ে বসল রাজীব। তার দিকে একপলক তাকিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সুবর্ণা। বলে, রাত হয়েছে। এবার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। রাজীবকে দেখিয়ে বলল, ইনিও এই ঘরে শোবেন। আপনার অসুবিধা হবে না।
কোনওরকম প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না। গাছ, পাথর বা অচেতন বস্তুর সঙ্গে কথা বললে যেমন উত্তর পাওয়া যায় না, এখানেও ঠিক তা-ই। মুখে সেই অদ্ভুত হাসিটি নিয়ে একইভাবে তাকিয়ে রইলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ।
হঠাৎ রাজীব বলে ওঠে, আই উইদড্র মিসেস সিংহ।
তার কথাটা বুঝতে না পেরে সুবর্ণা একটু অবাকই হল।
রাজীব বলে, তখন বলেছিলাম, আপনার গ্র্যান্ডফাদার-ইন-ল’র হাসি এবং তাকানোটা অ্যাক্টিং হতে পারে। এখন দেখছি, না, ওটা রিয়াল।
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
রাজীব ফের বলে, ওল্ড এজে পঙ্গু, অকর্মণ্য, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে বেঁচে থাকাটা হরিবল ব্যাপার।
একজন নিষ্ঠুর উগ্রপন্থী, যার কাছে মৃত্যু বা হত্যা চাঞ্চল্যকর কোনও ঘটনাই নয়, যার মাথার ওপর পঞ্চাশ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, যার কাছে বাঁচা এবং মরার মাঝখানে পার্থক্যটা বড়ই ক্ষীণ, বড়ই সূক্ষ্ম শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের এই পরিণতিতে সে যে বিচলিত হতে পারে, সেটাই অবাক করার মতো ব্যাপার।
মায়া গরম জল এবং দুধ খইটই নিয়ে আসে।
সুবর্ণা তোয়ালের একটা প্রান্ত গরম জলে ভিজিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের হাত পা মুখ সযত্নে মুছিয়ে ধরে ধরে তার খাটে নিয়ে বসিয়ে দেয়।
শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের জন্য জল এবং খাবার দিয়ে মায়া পালাতে চাইছিল। যেখানে একজন বিপজ্জনক আগন্তুক বসে আছে তার ধারে কাছে থাকাটা নিরাপদ নয়। কিন্তু তক্ষুণি আর যাওয়া হল না।
সুবর্ণা বলে, আমাদের স্টোরে বড় আলমারিতে বাড়তি লেপ তোষক মশারি টশারি আছে। সেগুলো এনে এ ঘরের ডিভানে বিছানা করে দাও।